১১ মে ২০১৮, শুক্রবার, ১১:০৭

শিক্ষার পেছনেই শেষ অভিভাবকের সম্বল

আহমদ আলী ও রোজিনা। তিন সন্তানের জনক এ দম্পতি। এক মেয়ে আর দুই ছেলে। সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা শেষ করিয়েছেন। বড় ছেলে আর মেয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার ডিগ্রি সমাপ্ত করেছেন। আর ছোট ছেলেটি অনার্স ডিগ্রি নিয়েছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
কর্মজীবনে ভালোই চলছিল মধ্যবিত্ত আহমদ আলীর পরিবার। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে লেখাপড়া শেষ করার পরেও যখন সন্তানরা চাকরির পিছনে বছরের পর বছর ছুটেও একটি চাকরি মিলাতে পারেনি। সন্তানদের সঙ্গে তিনিও হতাশ হতে থাকেন। বড় ছেলে এবং মেয়ে সরকারি চাকরির পিছনে ছুটেই পার করে দিয়েছেন তিন বছর। মেয়েটি একটি বেসরকারি ফার্মে চাকরি নিয়েছেন উপায়ন্ত না পেয়ে। অন্যদিকে দুই ছেলের উচ্চ শিক্ষা শেষ করানোর পরেও চাকরি না পাওয়ায় অনেকটা ভেঙে পড়েন পিতা। ইতিমধ্যে সরকারি কর্মকর্তা আহমদ আলীও অবসর নিয়েছেন। স্ত্রী ছিলেন গৃহিণী। তাই আয়ের উৎসও ছিলেন একমাত্র তিনি। এ অভিভাবকের আশা ছিল ছেলেরা লেখাপড়া শেষ করে নিজেদের ব্যয় নিজেরাই মেটাবেন। আর তিনি অবসর জীবনে মুক্তভাবে চলবেন। কিন্তু তার আশা এখন হতাশায় রূপ নিয়েছে। ছেলেদের চিন্তা নিয়ে থাকেন সর্বদা। কবে তাদের চাকরি হবে। কবে তিনি চিন্তা থেকে মুক্ত হবেন। আহমদ আলী মানবজমিনকে বলেন, ভাবছি একরকম হয়েছে আরেক রকম। ছেলে-মেয়েদের জন্য শিক্ষার জন্য বিনিয়োগ তো ব্যবসা নয়। তারা শিক্ষাজীবন শেষ করে একটা ভালো চাকরি পাবে এটাই তো প্রত্যেক মা-বাবার আশা থাকে। কিন্তু দেশে যেরকম অবস্থা তৈরি হয়েছে আশা শুধু নিরাশাই হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, মনে করেছিলাম ছেলে-মেয়েরা সরকারি চাকরি পাবে। তাদের একাডেমিক রেজাল্ট খুব ভালো। কিন্তু তা আর হচ্ছে না। এদিকে যারা ঘুষ দিতে পারেন তাদরে নাকি চাকরি হয়। বলেন, আমি যে বেতন পেতাম তা দিয়ে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া আর সংসারেই ব্যয় করেছেন। তাই চাকরির জন্য টাকা দেয়ার মতো কোনরকম সামর্থ্য তার নেই।
আবুল হাসান। মধ্যবিত্ত সংসারের ছেলে। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ, এমবিএ সমাপ্ত করেছেন। তাও তিনবছর আগে শেষ হয়েছে। বাবা কৃষক আর মা গৃহিণী। অনেক কষ্ট করে তার বাবা-মা পড়ালেখার খরচ দিয়েছেন। তারা মনে করেছেন ছেলের পড়ালেখা শেষ হতেই চাকরি পেয়ে যাবেন। নিজের ব্যয়ভার বহন করে তাদেরও কিছু দিতে পারবেন। সেখানে তিনবছর চেষ্টা করেও একটি চাকরি পাননি। পরিশেষে টিওশনি করিয়ে নিজের ব্যয় বহন করতে পারলেও পরিবারে কোনো টাকা-পয়সা দিতে পারেন না। তার কৃষক বাবার জন্য বাকি দুই ছেলের পড়ালেখা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আবুল হাসান বলেন, বাবা মনে করতো আমার পড়ালেখার পিছনে কষ্ট করে টাকা দিলে আমি আবার চাকরি পেয়ে দুই ভাইয়ের পড়াশোনা করাতে পারবো। সেখানে গত কয়েক বছর সরকারি-প্রাইভেট মিলিয়ে কতগুলো সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে ইন্টারভিউ দিলাম। কোনোভাবেই সোনার হরিণ চাকরিটি ধরা দিচ্ছে না। কি করবো এখন তা ভেবে পাচ্ছি না।

একজন শিক্ষার্থীর পিছনে পিতা-মাতার প্রতিবছর কত টাকা ব্যয় হয় তা নিয়ে জরিপ করছে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)। তাদের সর্বশেষ ২০১৬ সালের প্রতিবেদন বলছে, একজন প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীর পিছনে প্রতিমাসে খরচ হয় ৭১৭৩ টাকা, মাধ্যমিকে ৬৪৯৮ টাকা, উচ্চমাধ্যমিকে ৯৫৯৮ টাকা, ডিগ্রি পর্যায়ে (পাস কোর্স) ২০৮৭২ টাকা এবং অনার্সে ২০৯২৪ টাকা। সে হিসেবে একজন প্রাথমিক শিক্ষার্থীর পিছনে বছরে খরচ হয় ৮৬০৭৬ টাকা, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৭৭৯৭৬ টাকা, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ১১৫১৭৬ টাকা, ডিগ্রি (পাস কোর্স) ২৫০৪৬৪ টাকা এবং অনার্স পর্যায়ে ২৫১০৮৮ টাকা।
ব্যানবেইসের তথ্য অনুসারে, একজন শিক্ষার্থী তার চার বছরের অনার্স প্রোগ্রাম শেষ করেতই খরচ হয় ১০ লাখ টাকার উপরে। এর বাইরেও বিভিন্ন সময় অনেক আনুষঙ্গিক খরচ হিসেবে আরো টাকা ব্যয় করতে হয়। শিক্ষার্থীর শিক্ষার পিছনে এসব খরচের সিংহভাগই দিতে হয় পরিবারকে। কিছু অংশ আসে সরকারের শিক্ষা বরাদ্দ থেকে। আর কিছু শিক্ষার্থী টিওশনিসহ কোনো কোনো সময় কিছু টাকা উপার্জন করে ব্যয় করেন।

একজন শিক্ষার্থীর কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে তা জানতে ২০১৫ সালে দেশ প্রথমবারের মতো একটি জরিপ করে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তাদের তথ্যমতে, অভিভাবকরা প্রতি মাসেই একজন শিক্ষার্থীর স্কুল-কলেজের বেতন, ফি ও অন্যান্য খরচ ছাড়াই কেবল কোচিং ও প্রাইভেটের পেছনেই ব্যয় করেন ৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। জরিপ বলছে, একজন শিক্ষার্থীর বছরে তার শিক্ষার পেছনে যে টাকা ব্যয় হয়, তার ৩০ শতাংশই চলে যায় কোচিং এবং আর হাউস টিউটরের বেতন বাবদ। বিবিএস বলছে, সাধারণত শহরের শিক্ষার্থীরা কোচিং ও প্রাইভেট পড়তে গিয়ে বেশি টাকা খরচ করে আর তাদের খরচের হার ৩৩ ভাগ, আর গ্রামের শিক্ষার্থীরা ব্যয় করেন ২৬ ভাগ। একজন শিক্ষার্থীর মোট খরচের ৩৯ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে কোচিং করতে গিয়ে। এ ছাড়া ২৪ শতাংশ ব্যয় হয় যাতায়াত খরচে। বই, খাতা, কলম এবং পোশাকে যাচ্ছে বাকি টাকা।
২০১২ সালের জুনে চট্টগ্রাম অঞ্চল নিয়ে চিটাগাং রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (সিআরআই) একটি গবেষণা করে। তখন তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন শিক্ষার্থীর মোট খরচের ৩৯ ভাগ ব্যয় হয় কোচিং করতে গিয়ে। স্কুল শিক্ষাকে বিনামূল্যে ভাবা হলেও প্রতিটি পরিবার এখাতে প্রতি মাসে মোট ব্যয় করছে ৬ হাজার ৮৪ টাকা।

অনেক অভিভাবক বলেন, তাদের একজন সন্তানের শিক্ষাজীবনের পিছনে ব্যয় করতে হয় প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। যেসব পরিসংখ্যান এসব তথ্য দিচ্ছে তারা শুধু শিক্ষা ব্যয় হিসাব করছে। প্রকৃত চিত্র অনেক বেশি হবে। কেননা এর বাহিরে তার বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনাকাটা, হোস্টেল ব্যয় ইত্যাদি রয়েছে।
বিশিষ্টজনরা বলেন, পিতা-মাতার বিনিয়োগ থাকে কোনো প্রকার উৎকর্ষ পওয়ার আশা ছাড়াই। তারা কষ্ট করে, জীবনের সব আরাম-আয়েশ, আহ্লাদ ত্যাগ করে সন্তানকে মানুষ করেন। পড়ালেখা শেষ করে সন্তান যখন চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগেন তখন পিতামাতার হিসাবে এটা তাদের জন্য বড় কষ্টকর।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, চাকরি না পাওয়াতে পরিবারের মধ্যে একধরনের অসন্তুষ্টি দেখা যায়। কোনো বাবা-মা চান না তাদের সন্তান বেকার থাকুক। এটাই প্রথম প্রত্যাশা থাকে। দ্বিতীয়ত তারা চান, তার সন্তান নিজের আয় দিয়ে নিজেই আত্মনীর্ভরশীল হোক। যখন বাবা-মা স্বল্প আয়ের কিংবা দরিদ্র হন তখন তাদের প্রত্যাশা বাড়ে। এবং তখন তারা চান সন্তান তাদের সহায়তা করবেন। খুব খারাপ অবস্থা হলে সেসব পিতা-মাতা চান তাদের বরণ-পোষণের দায়-দায়িত্ব নিবেন। এই যে আমাদের দেশে পিতা-মাতার প্রত্যাশা তার নিরিখে কাজ না হওয়াটা, কর্মহীন থাকাটা তাদের চিন্তিত করে। এ অবস্থায় বাবা-মা সন্তানের পিছনে বিনিয়োগ নিয়েও ভাবে। এই যে তাদের পিছনে এত পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করছেন তা না করে অন্য কোনো শিক্ষার পিছনে কিংবা দক্ষতার পিছনে করলে সম্ভাবনা বেশি থাকতো।
এ গবেষক আরো বলেন, শিক্ষার্থীদের পিছনে অভিভাবকের বিনিয়োগের কথা বিবেচনা নিয়ে সরকারকে শ্রমবাজারের চাহিদার নিরিখে শিক্ষা কাঠামো ওইভাবে সাজাতে হবে। সাধারণ শিক্ষায় গ্রাজুয়েট না রেখে দক্ষতা বিষয়ক শিক্ষা বেশি দেয়। যেমন- কারিগরি, ভোকেশনাল ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা, বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা। এইভাবে যখন শিক্ষার বিভিন্ন সুযোগ থাকবে তখন বাবা-মা তার সন্তানের সাধারণ শিক্ষার পিছনে বিনিয়োগ না করে অন্যধরনের আয়বর্ধক দক্ষতায় বিনিয়োগ করবে। যাতে একটা সম্ভাবনা নিয়েই থাকবে। আর এটার পিছনে সরকারের শিক্ষা কাঠামো সাজানোর একটা ভূমিকা থাকতে হবে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=116889