১১ মে ২০১৮, শুক্রবার, ১১:০৫

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উদ্বেগ

বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকিতে। ৫৭ ধারার পরিবর্তে যে নতুন ডিজিটাল আইন প্রস্তাব করা হয়েছে তা আরো কঠোর। এ নিয়ে সাংবাদিকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাই মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেয়া উচিত বাংলাদেশ সরকারের। সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এতে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

বলা হয়েছে, নতুন আইনে নির্যাতনের ধারা নতুন করে আসা উচিত হবে না। নিউ ইয়র্ক থেকে বুধবার প্রকাশিত ‘নো প্লেস ফর ক্রিটিসিজম: বাংলাদেশ ক্র্যাকডাউন অন সোশ্যাল মিডিয়া কমেন্টারি’ শীর্ষক ৮৯ পৃষ্ঠার রিপোর্টে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অধীনে সরকারের সমালোচনা করায়, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ফেসবুকের অনেক ব্যবহারকারী, ব্লগার, অনলাইন সংবাদপত্র অথবা অন্য সামাজিক মিডিয়ার বহু সংখ্যক ব্যবহারকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল আনা হয়েছে বিদ্যমান আইনের স্থানে। এতেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা লঙ্ঘিত হচ্ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিখেছে, আগামী ১৪ই মে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে মানবাধিকার বিষয়ক রেকর্ড নিয়ে পরিষদের সামনাসামনি হবে বাংলাদেশ। ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ প্রক্রিয়ায় এ ঘটনা ঘটবে। এই সুযোগটি ব্যবহার করা উচিত বাংলাদেশ সরকারের। সেখানে প্রতিশ্রুতি দেয়া উচিত যে, তারা ভিন্ন মতাবলম্বী, সমালোচক, এমনকি তা যদি বিরোধীদলীয় রাজনীতিকরাও করেন তাদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন বন্ধ করা হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় জনসমাবেশ বা প্রচারণাকে সমর্থন দিতে হবে। তবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর সহিংস হামলার মধ্য দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে যারা দমিয়ে রাখতে চায় এমন কট্টরপন্থি গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস বলেছেন, বাংলাদেশ সরকারের মেনে নেয়া উচিত যে, বর্তমানে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা অত্যন্ত কঠোর। এটা বাতিল হওয়া উচিত। তবে এক্ষেত্রে যে নতুন আইন প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে এর থেকে তেমন উন্নতি লক্ষ্য করা যায় না। এতে নতুন করে কিছু ‘অফেন্সেস’ সৃষ্টি হতে পারে। নিঃসন্দেহে তা বছরের পর বছর ব্যবহার করা হতে পারে সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে, যেখানে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা উচ্চ মাত্রায় রাজনীতিকরণ করা। ৮৯ পৃষ্ঠার ওই রিপোর্টে বলা হয়, ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন সংশোধন করা হয় ২০১৩ সালে। এরপর খেয়াল খুশিমতো বহু মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইন সংশোধন করা হয়েছে শাস্তি কঠোর করার জন্য। পুলিশ অনুমতি পেয়েছে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তারের। ঢাকায় সাইবার ট্রাইব্যুনালে ২০১৮ সালের এপ্রিলে ১২৭১টি চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। তাতে বলা হয়েছে, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার অধীনে বিচার করার পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। অনেক মানুষকে মাসের পর মাস বন্দি করে রাখা হয়েছে। এর একটাই কারণ, তারা ফেসবুকে সমালোচনামূলক পোস্ট দিয়েছেন, না হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার আত্মীয়-স্বজন ও সহকর্মীদের ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন তারা। অন্যদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া অথবা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার অধীনে কোনো ব্যক্তি যদি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এমন তথ্য প্রকাশ করেন যা মিথ্যা ও আপত্তিকর, মানহানিকর, কারো সম্পর্কে কলুষিত বা দুর্নীতির বিষয়ে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটাতে পারে, যদি রাষ্ট্রের, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে, এমন তথ্য প্রকাশ করলে যেকোনো ব্যক্তিকে এই ধারায় বিচার করা যাবে। ২০১৩ সালে যে সংশোধনী আনা হয় তাতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার প্রয়োজনীয়তা অথবা বিচারের জন্য সরকারি অনুমতির কোনো প্রয়োজনীয়তা বাতিল করা হয়েছে। বিচার মুলতবি আছে এমন মামলায় বন্দির মুক্তির বিষয় সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। যদি কেউ দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে তার জেলের মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলা হয়। আইসিটি আইনের অধীনে অপরাধের বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি নতুন সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এর ফলে পুলিশের কাছে অভিযোগের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে গ্রেপ্তার ও প্রসিকিউশনের ঘটনা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিখেছে, প্রধানমন্ত্রীর পোশাক, তার পররাষ্ট্রনীতি, তার দল অথবা তার মন্ত্রিপরিষদের সহকর্মীদের সমালোচনা করার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিছু নাগরিককে। এক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক নেতাকর্মীর অভিযোগের ভিত্তিতে অথবা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। ২০১৮ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের পর পরই একজন পুলিশ কর্মকর্তা ফেসবুকে ৪৩টি ‘উস্কানিমূলক’ পোস্টের উল্লেখ করে একটি অভিযোগ দাখিল করেন। বলা হয়েছে, এর বেশির ভাগের সঙ্গে সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে এমন যোগসূত্র বা মন্তব্য রয়েছে। যার ফলে ৫৭ ধারার অধীনে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়। ২০১৭ সালের এপ্রিলে শ্রীমঙ্গলের রাবার উৎপাদনকারী শ্রমিক মনিরুল ইসলামকে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই পোস্টে প্রধানমন্ত্রীর চলমান ভারত সফর নিয়ে সমালোচনা করা হয়। এ নিয়ে দলীয় একজন সমর্থক পুলিশের কাছে অভিযোগ দাখিল করেন। তিনি তাতে উল্লেখ করেন, ওই পোস্ট ক্ষোভ সৃষ্টিকারী। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরো লিখেছে, ৫৭ ধারার অধীনে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকিতে। অনলাইনে দুর্নীতি, অপশাসন অথবা ব্যক্তিবিশেষের সমালোচনা করার কারণে অনেক সাংবাদিক ও সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি পদে মনোনয়ন নাও পেতে পারেন এমন একটি আশঙ্কামূলক খবর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশ করেছিলেন হবিগঞ্জ সমাচারের সম্পাদক গোলাম মোস্তফা রফিক। এ জন্য ২০১৭ সালের জুনে তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এছাড়া ত্রাণ সহায়তা দেয়া একটি ছাগল মারা যাওয়া নিয়ে ফেসবুকে প্রকাশিত একটি আর্টিকেল শেয়ার দিয়েছিলেন আবদুল লতিফ মোড়ল। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর মানহানি করার উদ্দেশ্য রয়েছে এমন অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় আবদুল লতিফকে। এই গ্রেপ্তারের পর ২০১৭ সালের জুলাইয়ে বিক্ষোভ প্রতিবাদ করেন বিপুলসংখ্যক সাংবাদিক। সাইবার ট্রাইব্যুনাল যদিও অভিযুক্ত ও খালাসপ্রাপ্তের কোনো সরকারি ডাটা দিতে পারেনি, তবে যেসব তথ্যপ্রমাণ রয়েছে তাতে বলা যায়, এখন পর্যন্ত দু’চারজন অভিযুক্ত হয়েছেন। মোদ্দাকথা হলো, অনলাইনে মতপ্রকাশ করার কারণে মানুষকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আটক করা হচ্ছে। এতে মতপ্রকাশ, ভিন্ন মতাবলম্বীদের মধ্যে এক হিম আতঙ্ক দেখা দিচ্ছে। ৫৭ ধারার অপব্যবহার হচ্ছে এটা স্বীকার করে সরকার এর পরিবর্তে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রস্তাব করেছে। তাদের দাবি, এতে মতপ্রকাশ নিয়ে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে এটি ভারসাম্য রক্ষা করবে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বর্তমানে বিলটি জাতীয় সংসদের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এটি অনুমোদন করা হলে তাতে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। প্রস্তাবিত এই আইনে এমন কিছু বিধি আছে যা ৫৭ ধারার চেয়েও কঠোর। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের সাংবাদিকরা। তারা মনে করেন, এই আইনে এমন কিছু বিধান আছে যার অধীনে দুর্নীতি বা অন্য কোনো অপরাধের প্রকাশের গোপন রেকর্ডিং ব্যবহার গুপ্তচরবৃত্তির পর্যায়ে পড়বে। এর ফলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের মিডিয়ার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, অস্থিতিশীলতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ‘ডিসটার্ব’ করে অথবা ‘ডিসটার্ব করে বলে মনে হয়, এমন কোনো ‘আগ্রাসী অথবা ভীতিকর’ তথ্য প্রকাশ করলে শাস্তি হিসেবে ১০ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। এমন অনেক অপরাধ আছে যাতে এভাবে জেল দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া প্রস্তাবিত আইনে একটি বিধানে বলা আছে যদি কেউ স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা অথবা জাতির জনকের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার প্রচারণার দায়ে অভিযুক্ত হন তাহলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া যাবে। এ নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরো লিখেছে, ৫৭ ধারার পরিবর্তে যে নতুন আইন পাস হবে তা আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করে, মতপ্রকাশকে সুরক্ষিত রাখে ও সম্মান জানায় এ বিষয়ে নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নিশ্চিত করা উচিত বাংলাদেশের। ব্রাড এডামস বলেছেন, সমালোচনাকে গ্রহণ করা উচিত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের, তা সেটা যতই অপছন্দের বা বেদনাদায়ক হোক। এই সমালোচনা জনজীবনের অংশ। এ থেকে ভুল সংশোধন হতে পারে। তাই একটি নতুন আইনের খসড়া করার সময় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করা উচিত সরকারের, যাতে মতপ্রকাশ ও ইন্টারনেটের স্বাধীনতা পূর্ণাঙ্গভাবে অক্ষুণ্ন থাকে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=116884