১৩ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:৫১

রাজনৈতিক চিন্তাধারার এক অধ্যায়

শাহ্ আব্দুল হান্নান

জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে রাজনৈতিক ইতিহাস এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। কলেজ স্তরে সামান্য কিছু আলোচনা হলেও একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেই রাজনৈতিক ইতিহাস পূর্ণাঙ্গভাবে পড়ানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই ইতিহাসের নামে যা পড়ানো হচ্ছে, তাতে রয়েছে মৌলিক গলদ। কেননা, রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারা সব সময়ই বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বমূলক হওয়া উচিত। কেবল কোনো একটি বা দু’টি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে এই ইতিহাসের নামে শুধু পাশ্চাত্যের চিন্তাধারাই শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। পাশ্চাত্য জগৎ ছাড়া অন্য কোনো জাতির ও অন্য কোনো দেশের রাজনীতি প্রবাহের ওপর বিন্দুমাত্র গুরুত্বারোপ করা হয় না। মনে হয় যেন রাজনৈতিক চিন্তা ও তার অনুশীলনের ক্ষেত্রে একমাত্র পশ্চিমের লোকদেরই অবদান রয়েছে; প্রাচ্যের কোনো দার্শনিকই বুঝি এ সম্পর্কে চিন্তা করেননি কোনো দিন। এই একদেশদর্শিতার হয়তো বা কিছু কারণও দর্শানো যেতে পারে; কিন্তু কোনো যুক্তিতেই শুধু পাশ্চাত্য চিন্তাধারার পটভূমিকায় লেখা রাজনৈতিক ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না।

উল্লিখিত সীমিত চিন্তাধারার আলোচনার ফলে রাজনৈতিক ইতিহাসে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের প্রথম পড়ানো হয় গ্রিক রাজনীতির কথা। বিশেষ করে সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল ও প্লেটোর চিন্তাধারা। তাদের পূর্বাপর অনেক দর্শন এবং গ্রিক সমাজের সাধারণ অবস্থাও এর সাথে গুরুত্বসহকারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। এ যুগের পর আসে রোমান রাজনৈতিক ইতিহাস, বিশেষ করে সিসেরোর রাজনৈতিক মতবাদ। প্রসঙ্গত, রোমান আইনের ওপরও আলোকপাত করা হয়। অতঃপর খ্রিষ্টীয় যুগের সূচনা। এ পর্যায়ে এসে প্রধানত অগাস্টিন, এমবোর্জ, গ্রেগরি প্রমুখ খ্রিষ্টান যাজকের সাথে; তাদের দর্শনের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। এ যুগের খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক অবধি। পঞ্চম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপীয় চিন্তাজগতে কোনো প্রতিভাবান রাজনৈতিক চিন্তাবিদের আবির্ভাব লক্ষ করা যায় না কিংবা নতুন কোনো রাজনৈতিক তত্ত্বেরও সন্ধান মেলে না। সবশেষে দ্বাদশ শতাব্দীর সাধু টমাস একুইনাস ও পদুয়ার মার্সিলিও থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত পশ্চিমের রাজনৈতিক চিন্তাধারা পড়ানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ যুগের রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে সমন্বয়বাদ আন্দোলন বা কনসিলিয়ারি মুভমেন্ট বিশেষ প্রসিদ্ধ। ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছে গতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং আমরা দেখতে পাই একের পর এক ম্যাকিয়াভেলি, মন্টেস্কু, হবস, লক, রুশো প্রমুখ অনেক রাজনীতিবিদকে।

ওপরের আলোচনায় দেখা যায়, দ্বাদশ শতাব্দীর কিয়দংশ ছাড়া পঞ্চম শতাব্দীর শেষ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত এক বিরাট রাজনৈতিক শূন্যতা। এই সুদীর্ঘ সময়ে সাধারণভাবে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা সামান্যই ছিল; যা ছিল তা-ও অত্যন্ত দুর্বল স্তরের। এ কারণেই দেখতে পাওয়া যায় দ্বাদশ শতাব্দীর সাধু একুইনাস, পদুয়ার মার্সিলিও-এর দর্শন এবং সমন্বয়বাদী আন্দোলনÑ সবই গির্জা ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের মতো সাধারণ প্রশ্নকে কেন্দ্র করে প্রবলভাবে আলোচিত হয়েছে। এ সমস্যা রাজনীতির মূল অধ্যায়ে পড়ে না, তথাপি ইউরোপীয় চিন্তাবিদরা এই সামান্য ব্যাপারকেই খুব ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লিখেছেন। এসব কারণে মধ্যযুগ, বিশেষ করে আদি মধ্যযুগকে ইউরোপীয় রাজনীতিবিশারদরাই অরাজনৈতিক যুগ বা ‘আনপলিটিক্যাল এজ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
আসলে তাদের এই মন্তব্য সত্য কি না তার যৌক্তিকতা বিচার করা দরকার। এ বিচার গোটা দুনিয়াকে সামনে রেখেই করা উচিত। আমাদের মতে, ওপরের মন্তব্য শুধু ইউরোপের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে, সারা বিশ্বের জন্য তা সত্য নয়।

খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে ঊষর আরব মরুর বুকে এক বিপ্লব এসেছিল, যা অনেক দিক থেকে ছিল অনন্য, অভূতপূর্ব। এ বিপ্লবের পুরোধা আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা:। এ বিপ্লব অন্য কোনো বিপ্লবের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। চিন্তা ও মতবাদের ক্ষেত্রে ইসলাম বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনল, বিশেষ করে রাজনৈতিক দর্শন ও চিন্তাধারায়। পুরনো রাজনীতির ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দেয়া হলো, উঠে দাঁড়ায় এক নব রাজনৈতিক আলোড়ন। নতুন নতুন পলিটিক্যাল ইনস্টিটিউশন সৃষ্টি হলো ওই যুগে। এ বিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল থিওরি ও প্র্যাকটিস অর্থাৎ, আদর্শ ও বাস্তবায়নের সমান্তরাল অগ্রগতি। থিওরির সাথে সাথে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন কায়দা-কানুন, শাসন-সংবিধান এবং বাস্তবে হয়েছে এর রূপায়ণ। কুরআনে যে রাজনৈতিক মতবাদ ঘোষিত হলো, পরে তারই বিভিন্নমুখী বিকাশ ও সমৃদ্ধি ঘটেছে বিভিন্ন দার্শনিকের হাতে। আল মাওয়ার্দী, ইমাম গাজ্জালী, ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়েম, ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন ও আল-ফারাবীর ভূমিকা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এদের বিস্তৃত চিন্তাধারা এ ুদ্র প্রবন্ধে পর্যালোচনা সম্ভব নয়। তবে পাশ্চাত্য রাজনৈতিক চিন্তাধারার সাথে সামঞ্জস্যশীল কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে।

ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক বা গির্জা ও শাসনক্ষমতার সম্পর্কের বিষয়টি চিরদিন ইউরোপের চিন্তাবিদদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে রেখেছে। ফলে শত শত বছর যুক্তি ও অস্ত্রের যুদ্ধ চলছে। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত রাজনৈতিক চিন্তাধারার। এ ছাড়া অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য ইউরোপে ছিল না। মুসলিম চিন্তাবিদেরা এ সম্পর্কে সুস্থ মত ব্যক্ত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম চিন্তাবিদেরা গির্জা ও রাষ্ট্র তথা ধর্ম ও রাজনীতি কখনো আলাদা করে দেখেননি। ইসলামের দৃষ্টিতে একটার ওপর অন্যটার প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নই ওঠে না, দুটো মিলেই এক। ইবনে খালদুন তার কিতাব আল ইবার বা বিশ্ব-ইতিহাস নামক গ্রন্থের ভূমিকায় ধর্ম ও রাজনীতিকে এক বলে উল্লেখ করেছেন। এ চিন্তাধারা আজ পর্যন্ত মুসলিমদের মধ্যে অুণœভাবে বিদ্যমান। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিরুদ্ধে আল্লামা ইকবালের তীব্র প্রতিবাদও এ ক্ষেত্রে অবশ্যই স্মরণীয়। তিনি বলেছেন, ‘একনায়কত্বের বিক্রমই হোক কিংবা গণতন্ত্রের তামাশাই হোক, রাষ্ট্র ও ধর্ম আলাদা হলে থাকে শুধু বর্বর শক্তি।’ মুসলিম চিন্তাবিদদের এই সুস্থ চিন্তাও আমাদের দেশের পাঠ্য রাজনৈতিক ইতিহাসের তালিকায় স্থান পায়নি।
অন্য দিকে, আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের সত্যিকার প্রথম বিকাশ ঘটেছে মুসলিম চিন্তাবিদদের হাতে। আইনশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানদের অবদান অতুলনীয়। অধুনা যে জুরিসপ্রুডেন্স অব ল পড়ানো হয়, এর প্রথম নিয়মমাফিক বিকাশ লক্ষ করা যায় মুসলিম মনীষীদের হাতে। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম শাফেয়ীর নাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মধ্যযুগের জার্মানদের আইন পড়ানো হয়, অথচ মুসলিম আইনবিদদের চিন্তাজগতের সঙ্গে পরিচয় লাভের কোনো ব্যবস্থাই নেই আমাদের পাঠ্যপুস্তকে।

উপরের আলোচনা থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, মধ্যযুগ আন পলিটিক্যাল ছিল না। ইউরোপের জন্য তা ‘অরাজনৈতিক’ যুগ হলেও আরব ও মুসলিম বিশ্বে তখন পরিপূর্ণ রাজনৈতিক যুগ। আমাদের উচিত রাজনৈতিক চিন্তাধারার এ শূন্যতাকে দূর করে বিশ্বে রাজনৈতিক ইতিহাসকে নতুন করে লেখা। রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে মুসলিম চিন্তানায়কদের যথাযোগ্য স্থান দিলে এ শূন্যতা দূর হবেÑ রাজনীতির ইতিহাস পাবে পূর্ণাঙ্গতা, সংশোধিত হবে একটি ঐতিহাসিক ভুল।
ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও মুসলিম মনীষীদের চিন্তাধারাকে প্রচলিত এবং আমাদের পাঠ্য রাজনৈতিক মতবাদের ইতিহাসের অংশ করে নিলে এক দিকে বর্তমান ইতিহাসের ইউরোপীয় একঘেয়েমি দূর হবে, অন্য দিকে পৃথিবীর মুসলিম রাষ্ট্রগুলো শাসন-সংবিধানে পাশ্চাত্য মতামত গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট পথ খুঁজে পাবে। বস্তুত যেকোনো ইসলামি রাষ্ট্রের পক্ষে উল্লিখিত মুসলিম রাজনীতিবিদদের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-গবেষণার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ এবং আদর্শের সঙ্ঘাতময় বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে একান্ত প্রয়োজনীয়।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/317540