১৩ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:৩৩

ঢাকায় বেপরোয়া যন্ত্রদানব

ঢাকার রাস্তায় বেপরোয়া যন্ত্রদানব। দিনের তীব্র যানজটে ও রাতের ফাঁকা রাস্তায় মরণখেলায় মেতে উঠে যানবাহনগুলো। দিনের গণপরিবহনের গতির প্রতিযোগিতা, আইন ভঙ্গ করে চলে লেগুনা, সিএনজি অটোরিকশা, রিকশা এমনকি কোথাও কোথাও পিকআপ ভ্যান। রাতে ঢাকার রাস্তা ফাঁকা হলেও জীবনের ঝুঁকি কমে না মোটেও। বরং রাতের ঢাকায় আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে বিলাসী জীবনযাত্রায় অভ্যস্তদের প্রাইভেট গাড়িগুলো। উচ্চশব্দে মিউজিক, হর্ন বাজিয়ে দ্রুত গতিতে রাজপথ কাঁপিয়ে ছুটে চলে তাদের গাড়ি।

অনেকেই মাতাল হয়ে ধরেন গাড়ির স্টিয়ারিং। ঘটে দুর্ঘটনা। পঙ্গু হচ্ছেন অনেকে। এমনকি জীবন দিতে হয় অনেককেই। প্রভাবশালী গাড়ির মালিকদের বেপরোয়া আচরণের ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। অনেক ক্ষেত্রেই মামলা হয় না।
সারা দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে পর্যন্ত প্রায় দুই সহস্রাধিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে এক হাজার ৮৪১ জনের প্রাণহানি এবং পাঁচ হাজার ৪৭৭ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে সারাজীবনের মতো পঙ্গু হয়েছেন ২৮৮ জন।

রাত বাড়ার সঙ্গে কমে ঢাকার যানজট। ফাঁকা রাস্তায় তখন অন্যরকম দৃশ্যপট। গতির প্রতিযোগিতায় নামে যানবাহন। বিশেষ করে এক শ্রেণির বিত্তশালীর ছেলেরা মেতে উঠে দ্রুত গতির প্রতিযোগিতায়। বিলাস বহুল গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামে তারা। গাড়িতে উচ্চ শব্দে বাজে গান। কখনও কখনও গাড়ির গ্লাস খুলে রাস্তায় ফেলে যায় বিয়ারের খালি ক্যান। মদে-বিয়ারে মাতাল গাড়ির তরুণ চালকসহ ভেতরে থাকা তরুণ-তরুণী। বেপরোয়া এসব গাড়ির চাপায়-ধাক্কায় প্রায় প্রাণ দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। নিহতের ঘটনা ঘটলেই তা থানা পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছায়। নতুবা প্রতি রাতের আহত হওয়ার ঘটনা থেকে যায় আড়ালে। গত সোমবার রাত দেড়টার দিকে উত্তরা জসিমউদ্দিন মোড় এলাকায় আহত হন মেহেদি হাসান নামে এক যুবক। দ্রুত গতির একটি প্রাইভেট কার তার মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিয়ে দ্রুত আব্দুল্লাহপুরের দিকে চলে যায়। মেহেদি জানান, গাড়িটি উচ্চ শব্দে গান বাজিয়ে দ্রুত যাচ্ছিল। তাৎক্ষণিকভাবে গাড়ির নম্বরটি দেখার সুযোগ হয়নি।

চলতি বছরের ৩রা ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডিতে বিএমডাব্লিউ গাড়ির চাপায় নিহত হয়েছেন প্রবাসী আব্দুল মোতালেব ডাবুল (৫৫)। রাত দেড়টার দিকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর হোয়াইট হল কমিউনিটি সেন্টারের সামনের সড়কে (ঢাকা মেট্টো-গ-৩৩-০০৬৫) উল্টো পথে গিয়ে পথচারীদের ওপর গাড়ি তুলে দিলে মোতালেব মারা যান। ঘটনার দিন গাড়ির মালিক যুবক আল আমিন তার বন্ধু সানি ও সানির স্ত্রী জারাকে নিয়ে ঘুরতে বের হন। তারা তিনজনই মাদকসেবী। মোহাম্মদপুর থেকে চারটি ইয়াবাও কিনেছিলেন আল আমিন। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে পথে আরও দুটি গাড়িকে ধাক্কা দেয় নাজমুল হুদা আল আমিনের বিএমডাব্লিউ গাড়িটি। এ ঘটনায় আল আমিন ও সানিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শিগগিরই এই মামলার চার্জশিট জমা দেয়া হবে বলে জানান ধানমন্ডি থানার ওসি আব্দুল লতিফ।
সম্প্রতি যাত্রীবাহী দুই বাসের চাপায় হাত হারান তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। একইভাবে বাসের চাপায় পা হারান রোজিনা। এই রেশ কাটতে না কাটতেই গত ৪ঠা মে মালিবাগে যাত্রীবাহী বাসের চাপায় আহত হয়েছেন পোশাক শ্রমিক নিলুফা ইয়াসমিন। ছয় নম্বর বাস থেকে মালিবাগে যানজটের মধ্যে নামতেই যানজট কমে যায়। তাড়াহুড়া করে গাড়ি চালাতে গিয়ে নিলুফার ডান পায়ের ওপর বাসের চাকা তুলে দেন চালক। তার ছেলে আশিক জানিয়েছেন, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে দুইবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে নিলুফার। পায়ের চারটি আঙুল কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে। তবু তার পা সুস্থ হবে কি-না এ নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে জানান তিনি। নিলুফা ইয়াসমিন গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার নিজামকান্দি গ্রামের আজিজুল কাজীর স্ত্রী। এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।

একইভাবে বেপরোয়া প্রাইভেট কারের ধাক্কায় হাত-পা ভেঙে গেছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মেডিকেলের ডাক্তার শাওন আনোয়ারের। শাওন জানান, ১৪ই মার্চ দুপুরের দিকে মোটরসাইকেলযোগে খামার বাড়ি মোড় পেরিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে ঢুকার সময় ঘটে ঘটনাটি। পেছন থেকে একটি প্রিমিও প্রাইভেট কার তার বাইককে ধাক্কা দেয়। এতে পড়ে যান তিনি। শাওনকে ওই কারের বাম্পারে আটকিয়ে টিএন্ডটি অফিস পর্যন্ত নিয়ে যায়। এতে গুরুতর আহত হন তিনি। বাম হাতের কব্জি, বাম হাঁটুর নিচে অন্তত তিনটি স্থানে গুরুতর জখম হয়। হাত-পা ভেঙে যায়। এমনকি হাঁটুর দুটি লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। আরও তিন মাস পর তা অপারেশন করতে হবে। ডা. শাওন আনোয়ার জানান, দুর্ঘটনার পরপর গাড়ি আটক করেছিল পুলিশ। কিন্তু পুলিশ কোনো মামলা করলো না। গাড়ি ছেড়ে দিল। এমনকি সাত দিন পরে ওই গাড়ির কাগজপত্রও তার মালিকের কাছে হস্তান্তর করেছেন শেরেবাংলা নগর থানার এসআই আনিস। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে এসআই আনিস বলেন, ‘দুপক্ষকে ডেকেছিলাম। আহত ডাক্তার শাওন আনোয়ার আসেননি তাই ঊর্ধ্বতন অফিসারের পরামর্শে কাগজপত্র মালিকের কাছে দিয়ে দিয়েছি।

গত ৪ঠা মে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মোহাম্মদ শাওন নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। ওই দিন সকালে আরামবাগ জমিদারবাড়ি রাস্তা পারাপারের সময় একটি পিকআপ শাওনকে ধাক্কা দেয়। এতে তিনি গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। প্রতিদিনই এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। যানজটের মধ্যে, ফাঁকা রাস্তায় ঘটছে দুর্ঘটনা।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে মাত্র ১৬ লাখ চালকের লাইসেন্স রয়েছে। অথচ চালক রয়েছে প্রায় ৭০ লাখ। আবার অনেক অদক্ষ চালকদেরও রয়েছে ড্রাইভিং লাইসেন্স। একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে এই লাইসেন্স সংগ্রহ করে তারা। এই চালকরাই সড়কে হয়ে উঠেন ভয়ঙ্কর। মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠে তাদের যানবাহন। একইভাবে মাতাল ও বেপরোয়া চালকদের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা।

এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, ট্রাফিক আইনের বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। সচেতনতা সৃষ্টি করতে প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করতে হবে। এতে অনেক দুর্ঘটনা কমে যাবে। রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে সৎ ও দায়িত্বশীল আচরণ করা আবশ্যক। কোনোভাবেই অবৈধভাবে চালকদের লাইসেন্স দেয়া যাবে না। একইভাবে অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা মদ্যপ অবস্থায় কেউ যেন গাড়ি না চালায়, তা কঠোরভাবে দমন করতে হবে। একটি দুর্ঘটনা অনেক মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারে। অনেক সংসারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এই সমাজবিজ্ঞানী।

 

http://mzamin.com/article.php?mzamin=117169