১৩ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:৩২

ক্রেতা নয়, ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য মূল্যতালিকা

পবিত্র রমজানে ইফতারের প্রিয় খাবার ছোলা। সেই ছোলা চট্টগ্রাম মহানগরীর সব ক’টি বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা। যা সর্বোচ্চ ৭০ টাকা কেজি নির্ধারণ করে সরকার। এ বিষয়টি জানাও ছিল না ক্রেতা মো. জুনাইদের। শনিবার বিকেলে নগরীর বহদ্দারহাটের হাটহাজারী স্টোর থেকে ছোলা কিনতে যান তিনি। সঙ্গে চিনি, পিয়াজ, রসুন, মসুর ডাল
, সয়াবিন তেলসহ নানা প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের অর্ডার করেন তিনি।
কিন্তু হঠাৎ মূল্য তালিকা টাঙিয়ে দেয়ার পর নজর কাড়ে তার। ছোলার দাম লেখা ৭০ টাকা, রসুন ৮০ টাকা, পেয়াজ ৩২ টাকা, চিনি ৫৫ টাকা, মসুর ডাল ৯৮ টাকা। কিন্তু তার থেকে মূল্য নেওয়া হয়েছে ছোলা ৭৮ টাকা, রসুন ১০০ টাকা, পেয়াজ ৩৫ টাকা, চিনি ৬৫ টাকা, মসুর ডাল ১১৫ টাকা প্রতিকেজি। এ নিয়ে দোকানদারের সঙ্গে দেনদরবার শুরু হয় তার। তখনই এক দোকানদার বললেন, মূল্য তালিকা ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য, কাস্টমারদের (ক্রেতা) জন্য নয়। কাস্টমারদের জন্য মূল্য আরো বেশি। আর এ কথায় নির্বাক ক্রেতা মো. জুনাইদ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সব সম্ভবের দেশ এইদেশ। যেখানে আমাদের মতো মানুষের জন্ম নেয়াটাই পাপ। এ কথায় ক্রেতার উপর একরকম চড়াও হওয়ার অবস্থা দোকানদারের। যা দেখে ভিড় করেন আরো কয়েকজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু সবাই দর্শক। জটলা দেখে সমস্যা বুঝে প্রশ্ন করতেই দোকানের ক্যাশিয়ার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভাই আমাদের দোষারোপ করে লাভ কি?। পাইকারি বিক্রেতাদের বলেন। আমরা তো সামান্য লাভে মাল বিক্রি করি। কিন্তু সরকারি মূল্যে মাল বিক্রি করলে পুঁজিও থাকবে না।

তিনি বলেন, ব্যবসা করে খাই বলে সবকিছু সহ্য করতে হচ্ছে। প্রশাসনকে বুঝাতে মূল্যতালিকা করা হয়েছে। কিন্তু সেই তালিকা টাঙালে ক্রেতাদের সঙ্গে আমাদের শুধু ঝগড়াই হবে। মাল আর বেচতে হবে না। তাই ম্যাজিস্ট্রেট কখন আসে খবর পেলেই তালিকা টাঙায়। আর তালিকা দেখেই ঝগড়া শুরু করে এই ক্রেতা।
ক্রেতা জুনাইদ বলেন, বহদ্দারহাট সংলগ্ন মোহাম্মদপুর আবাসিক এলাকায় আমার বাসা। এই দোকানের নিয়মিত ক্রেতা আমি। কিন্তু কোনো সময় দোকানে মূল্য তালিকা টাঙাতে দেখিনি তাদের। অবশ্যই শুধু এ দোকানে নয়, হাটের কোনো দোকানেই মূল্যতালিকা নেই। হঠাৎ ম্যাজিস্ট্রেট আসার খবরে দোকানের সবাই মূল্যতালিকা টাঙিয়েছে। কিন্তু পণ্য বিক্রয় হচ্ছে আরো বেশি দামে।
ব্যবসায়ীরা জানান, রমজানকে সামনে রেখে সরকার নির্ধারিত মূল্যতালিকা টাঙানো হয়েছে কিনা তা দেখতে এবং বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রি, ওজনে কারচুপি ও ভেজালের বিরুদ্ধে শনিবার দুপুরে মাঠে নামে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

এর মধ্যে নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজার, ২নং গেট কর্ণফুলী কমপ্লেক্স, চকবাজার, বহদ্দারহাট, কর্ণফুলী কাঁচাবাজার ও স্টিলমিল বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে জেলা প্রশাসন। এ সময় জরিমানার পাশাপাশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করে দিয়েছেন অভিযান পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ।
নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজার ও কাজীর দেউড়ি বাজারে অভিযান চালান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মোরাদ আলী। তিনি বলেন, বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়া এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ঘি বিক্রির দায়ে রেয়াজুদ্দিন বাজার মেসার্স কামাল স্টোর নামে একটি মুদির দোকানকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের দায়ে ঘোষ সুইটস মিষ্টির দোকানকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পরবর্তীতে কাজীর দেউড়ির কাঁচাবাজারে অভিযান পরিচালনা করি। মূলত ব্যবসায়ীদের সতর্ক করতে এই অভিযান চালিয়েছি আমরা।

তাদের বলেছি, কোনোভাবেই ভোক্তাদের কাছ থেকে বেশি দাম রাখা যাবে না। দোকানে ক্রয়-বিক্রয় মূল্য টাঙাতে হবে। তবে আমাদের অভিযান যেহেতু চলমান থাকবে, সামনে এই নির্দেশনা কেউ না মানলে আমরা তখন জরিমানা করবো।
এদিকে চকবাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রঞ্জন চন্দ্র দে। তিনি বলেন, কোনো ধরনের জরিমানা করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু তারপরও ভোক্তা অধিকার হরণ করার দায়ে চকবাজারের আলী মাংস স্টোরকে ৫০০ টাকা জরিমানা করেছি। এছাড়া সকল ব্যবসায়ীকে সতর্ক করা হয়েছে। একই সঙ্গে পণ্যের ক্রয় ও বিক্রয় মূল্য টাঙানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নগরীর ২নং গেট কর্ণফুলী কমপ্লেক্সে অভিযান পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নওশের ইবনে হালিম। তিনি বলেন, সাধারণত রমজান মাস এলেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে অধিক মুনাফা করার একট প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সব দোকানে যাতে ক্রয় মূল্য ও বিক্রয় মূল্য টাঙানো হয় সে ব্যাপারে বাজার কমিটির সভাপতি এবং দোকানদারদের নির্দেশনা দিয়েছি। প্রথমদিন হিসেবে কোনো ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়নি। সবাইকে আপাতত সতর্ক করা হয়েছে।
চৌমুহনী কর্ণফুলী কাঁচাবাজার ও স্টিলমিল বাজারে পরিচালিত অভিযানে নেতৃত্ব দেন খোশনূর রুবাইয়াৎ। তিনি বলেন, রমজানকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের সতর্ক করতেই মূলত এই অভিযান পরিচালনা করেছি। তবে কিছু কিছু দোকানে অবশ্যই মূল্যতালিকা টাঙানো দেখেছি। আমরা আসার খবর পেয়ে তারা এটা করেছে সেই খবরও পেয়েছি।

ক্রেতাদের অভিযোগ, সারা বছর মূল্যতালিকা না টাঙানো, ওজনে কারচুপি, নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বৃদ্ধি, ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য বিক্রিসহ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও ম্যাজিস্ট্রেট বা প্রশাসন কোনো খবর রাখে না।
নগরীর চকবাজারে রমজানের ভোগপণ্য কিনতে আসা মো. ইসহাক মিয়া অভিযোগ করে বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট এলে দোকানে মূল্য তালিকা টাঙানো হয়। কিন্তু চলে যাওয়ার পরে সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরে যায়। সারা বছর তো কোনো খবরও থাকে না। রমজান এলে সরকারও পণ্যমূল্য নিয়ে গরম বক্তব্য দিয়ে জনগণকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে। ব্যবসায়ীদের কিছুই হয় না।

 

http://mzamin.com/article.php?mzamin=117167