১৩ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:৩১

রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাচ্ছে দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদনে সরকারি নিষেধাজ্ঞার পরও রাজনৈতিক বিবেচনায় আরো প্রায় ২ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিচ্ছে সরকার। পুরোপুরি গোপনে এ কাজটি করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। গত বৃহস্পতিবার এ তালিকা চূড়ান্ত করেছে মন্ত্রণালয়। অনুমোদনের বিষয়টি প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হওয়ার কথা থাকলেও এবার তা হচ্ছে না। চাপ সামলাতে নতুন কৌশল নেয়া হয়েছে। অনুমোদন প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হবে।
আজ কালের মধ্যে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
তবে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। বিষয়টি রাজনৈতিক বিবেচনায় হওয়ায় তারা কোনো কথা বলতে চান না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আফসারুল আমিন মানবজমিনকে বলেন, এবার নির্বাচনী বছর, সেজন্য নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের জন্য এলাকার একটা চাপ আমাদের ওপর আছে। বিষয়টি একদম চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে এ বিষয়ে আমি অবগত নই। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান অনুমোদন আর এমপিওভুক্তি এক জিনিস না। তাই অনুমতি দিলেই যে এমপিও দিতে হবে সেটার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন দিতেই পারে। একাধিক এমপির সঙ্গে কথা বলে স্কুল-কলেজে অনুমোদনের চাপের বিষয়টি জানা গেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বর্তমানে দেশের নতুন করে কোনো স্কুল-কলেজের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এসব অনুমোদন বন্ধ করে রাখা হয়। কিন্তু সম্প্রতি সরকারের প্রভাবশালী কয়েকজন মন্ত্রী ও এমপিদের চাপে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পেতে যাচ্ছে নতুন স্কুল-কলেজ। আর বিষয়টি অতিগোপনে শিক্ষা মন্ত্রালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ তালিকা করেছে।

সম্প্রতি পঞ্চগড়-২ আসনের এমপি নুরুল ইসলাম সুজন তার নির্বাচনী এলাকা পঞ্চগড়ের দেবিগঞ্জ উপজেলার হাজির হাট নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানের অনুমতির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইনকে তার কক্ষে এসে চাপ প্রয়োগ করেন। অপরদিকে ওই এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা সচিবকে ফোন করে বলেছেন, একটি রাস্তা শেখ রাসেল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও হাজির হাট নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে দূরত্ব গড়ে তুলেছে। নতুন স্কুলের অনুমোদন দিলে উভয় প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী সংকটে পড়বে। মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে নতুন স্কুলের অনুমোদন দেয়নি। তার পরও চাপ দেন এমপি। বিষয়টি স্বীকার করে নুরুল ইসলাম সুজন মানবজমিনকে বলেন, সচিবকে চাপ দেইনি। বুঝানোর চেষ্টা করেছি। অনেক দিন হয়েছে এ স্কুলটির অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা রাজনীতি করি। জনগণের কথা শুনতে হয়। এখানে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।

মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, গত বছর ৩১শে ডিসেম্বর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমতি, একাডেমিক স্বীকৃতি, অতিরিক্ত শ্রেণি, নতুন বিষয়-বিভাগ খোলা সংক্রান্ত কমিটির সভা হয়। কমিটির আহ্বায়ক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) জাবেদ আহমেদ সভাপতিত্বে সভায় ৪৯৬টি স্কুল ও কলেজ পাঠদানের অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে এরই মধ্যে বিগত দিনে একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রায় ১০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি না করায় আন্দোলনে নামেন শিক্ষকরা। হাজার হাজার শিক্ষক শীতের মধ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে টানা অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। শিক্ষকদের আন্দোলনে বিব্রত হয় সরকার। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত করে বাড়ি ফিরে যায় শিক্ষকরা। ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মৌখিকভাবে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। তবে থেমে থাকেননি মন্ত্রী, এমপি, প্রভাবশালী নেতা ও আমলারা। তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অব্যাহত চাপ দিতে থাকেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার একজন যুগ্ম সচিবের কক্ষে কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে এ তালিকা চূড়ান্ত করেছেন। তাতে অন্তত ২০০ স্কুল ও কলেজের নাম রয়েছে। তালিকাটি ওই দিন শেষ বিকালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছে জমা দেয়া হলে তিনি অনুমতি দিয়েছেন। বিগত দিনে স্কুল-কলেজের অনুমতির চিঠি মন্ত্রালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হলেও এবার তা দেয়া হবে না। যাদের স্কুল-কলেজ বাদ পড়েছে তাদের চাপ সামলাতে এ কৌশল নেয়া হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

১৯৯৭ সালের বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও স্বীকৃতি নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি আট হাজার জনসংখ্যার জন্য একটি নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের (৬ষ্ঠ-৮ম), ১০ হাজার জনসংখ্যার জন্য একটি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল বা মাদরাসা) এবং ৭৫ হাজার জনসংখ্যার জন্য উচ্চমাধ্যমিক স্তরের (কলেজ-আলিম মাদরাসা) প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়ার কথা। দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দূরত্বের শর্ত অনুযায়ী নিম্ন মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে পৌর এলাকায় এক কিলোমিটার ও মফস্বল এলাকায় ছয় কিলোমিটার। মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে মফস্বল এলাকায় চার কিলোমিটার আর উচ্চ মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে পৌর এলাকায় দুই কিলোমিটার আর মফস্বল এলাকায় ছয় কিলোমিটার শর্ত রয়েছে। পুরনো এই নীতিমালার কারণে একদিকে প্রতিষ্ঠানে অধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে থাকে। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ঠিক থাকে না বিধায় শিক্ষার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবার বাস্তব প্রয়োজনের কারণে প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=117173