১৩ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:২৯

বিদেশী বায়াররা বলেন, আমরা অতিষ্ঠ আমাদের আর এ দেশে এনো না’

‘ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ বা কাঁচপুরে যেতে যে সময় লাগে সেই সময়ে বিমানে করে দুবাই চলে যাওয়া যায়। ‘বিদেশী বায়াররা বলে আমরা অতিষ্ঠ, আমাদের আর এ দেশে এনো না। তাই যানজট থেকে মুক্তির জন্য ক্রেতাদের হেলিকপ্টারে চড়িয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। এ দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন! রফতানির জন্য বিদেশ থেকে কাঁচামাল আনা হয়। কিন্তু তা বিমানবন্দর থেকে হারিয়ে যায়। ফলে একই জিনিস তিনবার আমদানি করতে হয়। বন্দরের মাল খালাস করতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। এতে লিড টাইম চলে ধরে রাখা যায় না। বড় ঋণখেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিল করে দেয়া হয়। আর আমাদের ঋণে সুদ দিতে হয় ১২ শতাংশ। এ পরিবেশে দেশের ব্যবসায়ীরা কিভাবে রফতানিতে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা ধরে রাখবে। ’

‘এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তীতে করণীয় নির্ধারণ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর এ কথা বলেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং(সানেম) তাদের নিয়মিত প্রকাশনা ‘থিঙ্কিং এলাউড’ এর চার বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল বনানীর এক হোটেলে এ গোলটেবিল বৈঠকটির আয়োজন করেছিল। সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও গবেষণা সংস্থা পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ, বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কে এ এস মুরশিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সানেমের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. বজলুল হক খোন্দকারও বক্তব্য রাখেন।
দেশে ‘কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি’ হচ্ছেÑ উল্লেখ করে সানেমের গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ভালো নয়। ২০১৩ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মধ্যে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হলেও এ সময়ে বার্ষিক গড় কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। এ সময়ে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে ৭ লাখ ৭০ হাজার। নারীদের কর্মসংস্থান কমেছে ৯ লাখ ৯০ হাজার। যুব বেকারত্বের হার ৮ দশমিক ১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। লিঙ্গভিত্তিক মজুরি বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল স্থির।’

নাসিম মঞ্জুর বলেন, যারা টপ কাস ঋণখেলাপি তাদের জন্য বিনা কিস্তি ১০-১২ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিল করে দেয়া হয়েছে। আর আমরা যারা খেলাপি নয়, তাদের সুদ দিতে হয় ১২ শতাংশ। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি বলেন, এক বছরে ব্যবধানে ঋণের সুদের হার সাড়ে তিন শতাংশ বেড়ে গেছে। আমাকে সাড়ে ৩ শতাংশ বাড়তি সুদ দেয়ার জন্য ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে। এভাবে চললে ব্যবসায় করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, একজন্য বড় ব্যবসায়ী বলেছেন, তিনি তিন বছর ধরে তার কারখানায় নতুন কোনো লোক নিয়োগ দিচ্ছেন না। উপরন্তু প্রতি মাসে তাকে লোক ছাঁটাই করতে হচ্ছে। কারণ তার ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। ব্যবসার অবস্থা ভালো কিভাবে হবে। কারণ এখানে ব্যবসায় করাটি কঠিন হয়ে পরছে। ভিয়েতনামে ব্যবসায়িক পরিবেশের সাথে দেশে ব্যবসায়িক পরিবেশের তুলনা করে তিনি বলেন, ভিয়েতনামে জমির দাম বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম, সে দেশে বিদ্যুতের দাম বাংলাদেশের অর্ধেক। তেলের দামও বাংলাদেশের চেয়ে কম। এখন বিনিয়োগকারীরা সেখানে বিনিয়োগ করবে না তো কি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে। প্রশ্ন রাখেন তিনি।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০২৪ সালে আমাদের এলডিসি থেকে পুরোপুরি উত্তরণের ফলে ব্যবসায়িক ব্যয় বেড়ে যাবে এ কথা যেমন ঠিক, তেমনি ব্যবসায় করার সুযোগও আসবে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্থা সম-মূলধন বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। তিনি বলেন, এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ট্যারিফ বেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা না করে ট্রেড ফ্যাসিলিটেশনের দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার। কে এ এস মুরশিদ দেশে অদক্ষতা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের দেশে এত ইনএফিসেন্সি যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এ ইনএফিসেন্সি আমাদের দূর করতে হবে।
ড. সাদিক দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির দুর্বলতাগুলো তুলে ধরে বলেন, এ দেশে কর-জিডিপির অনুপাত খুবই কম। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতেও সমস্যা রয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাজেট থেকে অর্থ দিয়ে কোনো বেসরকারি ব্যাংক বাঁচানোর প্রয়োজন নেই।

সানেমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০১৮ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রথম পর্যালোচনায় তিনটি মানদণ্ড সফলভাবে পূরণ করেছে। আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ ২০২১ সালের দ্বিতীয় পর্যালোচনায়ও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের মাপকাঠিগুলো পূরণ করতে সম হবে এবং ২০২৪ সালে চূড়ান্তরূপে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে পারবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ফলস্বরূপ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে উজ্জ্বলতর হবে এবং আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থাগুলো দ্বারা প্রদত্ত রেটিংয়ে উত্তরণ ঘটবে, যা আরও প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সাথে সাথে বেশ কিছু ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হবে। এর মধ্যে টেকসই উন্নয়ন ল্যমাত্রা অর্জনের প্রক্রিয়ায় স্থবিরতা প্রধানতম।
যদি বাংলাদেশ ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণ করে আসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত এবং চায়নার বাজারগুলোতে ২০২৭ সালে অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার হারাবে। ফলে বাংলাদেশের মোট বার্ষিক রফতানির ১১ শতাংশ হ্রাস পাবে, যার অর্থমূল্য রফতানি প্রবৃদ্ধির বর্তমান হিসাব অনুযায়ী ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাশাপাশি বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য হিসেবে নানাবিধ সুবিধা যেমন শুল্ক হ্রাস, ভর্তুকি এবং মেধাসত্ত আইনে শিথিলতা (বিশেষ করে ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরের েেত্র) সুবিধা ভোগ করছে, যা ২০২৭ সালের পর আর থাকছে না। যেহেতু বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের নি¤œœ আয়ের দেশ থেকে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, স্বল্পসুদে ঋণ গ্রহণের সুযোগ কমে আসবে এবং ফলস্বরূপ ব্যালেন্স অব পেমেন্টে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এেেত্র উপরোল্লিখিত সুবিধাগুলো প্রাপ্তির বিষয়টি ‘স্বয়ংক্রিয়’ না হলেও উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়ে গেলে ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে’ এ সুবিধাগুলো হারাবে। ’

বলা হয়, নি¤œœ আয়ের থেকে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়াটা সহজসাধ্য কাজ নয়। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে উন্নত দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ হতে ঋণ নেয়ার েেত্র তুলনামূলক বর্ধিত হারের সুদ প্রদান করতে হবে। উপরন্তু ঋণ পরিশোধের সময়সীমা কমে আসবে এবং যেহেতু অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত কর্মীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই আনুপাতিক হারে কর্মী মজুরি কমে আসবে। যদিও বাংলাদেশ উন্নয়নের েেত্র সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর থেকে ভালো করেছে কিন্তু দণি এশিয়া ও আফ্রিকার দ্রত উন্নয়নশীল দেশগুলোর থেকে অনেক পিছিয়ে আছে।
বিনিয়োগবান্ধব নীতির অভাব, দুর্বল প্রতিযোগিতা, সংবেদনশীল প্রকল্প বাস্তবায়নের েেত্র দীর্ঘসূত্রতা, ব্যয়বহুল প্রকল্প এবং দুর্বল অবকাঠামোর কারণে বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগের েেত্র শ্লথ গতি পরিলতি হচ্ছে।

আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণগত মানের উন্নয়ন, বাণিজ্যনীতি, মুদ্রা ও রাজস্বনীতি, শিল্পনীতির সংস্কার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান বৃদ্ধি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে সানেমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বলা হয়, দণি এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও শিা খাতে সরকারি ব্যয় নি¤œœ ব্যয়ের দেশগুলোর মধ্যে একটি এবং আউট অফ পকেট স্বাস্থ্য ব্যয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার প্রয়োজনে দেশের উল্লেখযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন জরুরি, যেহেতু ডুয়িং বিজনেস র্যাং কিংয়ে বাংলাদেশ সর্বনি¤œœগুলোর মধ্যে একটি বলে উল্লেখ করা হয়।
গোলটেবিলে অন্যান্যের মধ্যে ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলী আহমেদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মুনির চৌধুরী, সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও বক্তব্য রাখেন।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/318024