ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাইয়ে দীর্ঘ যানজট
১৩ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:২৮

শত কিলোমিটার যানজটে যাত্রী দুর্ভোগ চরমে

এম মাঈন উদ্দিন মিরসরাই (চট্টগ্রাম) ও সিরাজুল ইসলাম ফরায়েজী চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা)

বিরক্তি, অস্বস্তি, আতঙ্ক ও চরম দুর্ভোগের অপর নাম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। গত তিন দিনের ভয়াবহ যানজটে দিশেহারা এই সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী হাজার হাজার চালক ও যাত্রী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে জগদ্দল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার গাড়ি।
দেশের লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত এই মহাসড়কে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী ফতেহপুর থেকে শুরু হয়ে এই যানজট গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের কুমিরা পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ হচ্ছে।

জানা গেছে, তিন দিন মহাসড়কের যানজট গত কয়েক বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। প্রত্যদর্শী ও ভুক্তভোগীদের থেকে জানা যায়, যানজটে অনেক মহিলা ও শিশু পথে খাবার ও স্যানিটেশন সঙ্কটে অসুস্থ হয়ে গেছে।
হাইওয়ে পুলিশের জোরারগঞ্জ ফাঁড়ির ইনচার্জ সোহেল সরকার জানান, ফেনীর ফতেহপুর রেল ওভারপাস নির্মাণের স্থলে বিকল হয়ে যাওয়া ট্রাক অপসারণে বিলম্ব হওয়ায় এই যানজট সৃষ্টি হয়েছে, যা এই পর্যন্ত লেগেই আছে। তবে হাইওয়ে ও থানা পুলিশ সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করে মহাসড়ক সচল রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এত বেশি যানবাহন ও মালবাহী গাড়ি যে জন্য যানজট আর ছোট করা সম্ভব হয়নি।
এ দিকে তীব্র যানজট ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে মিরসরাইয়ে দু’জন এবং সীতাকুণ্ডে একজন নিহত হয়েছেন। গতকাল শনিবার সকাল ৭টায় সীতকুণ্ডের বাড়ককুণ্ড এলাকায় উল্টো পথ দিয়ে আসা একটি লরির ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই অজ্ঞাত ব্যক্তি নিহত হন। কুমিরা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট মাসুদ অজ্ঞাত পথচারীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আগের দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় মিরসরাইয়ে মিঠাছড়া বাজারের দক্ষিণ পাশে উল্টো পথে আসা একটি বাসের ধাক্কায় সাইফুল ইসলাম মিসু নামে এক যুবক ঘটনাস্থলে নিহত হন। বৃহস্পতিবার মিঠাছড়া বাজারে অজ্ঞাত এক ভিক্ষুক জানজটের কারণে দ্রুতগতিতে আসা একটি ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হন।
এ দিকে গতকাল থেকে শুরু হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ¯œাতক প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। যানজটের কারণে পরীক্ষার্থীরা সকাল থেকেই হল অভিমুখে বের হয়ে পড়েন। সীতাকুণ্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা মিরসরাই কলেজকেন্দ্রে পরীক্ষা দিচ্ছে। বেলা ২টায় পরীক্ষা শুরু হলেও সকাল ৮টার আগেই অনেককে বাসা থেকে বের হতে হয়েছে।

শুক্রবার সকাল ১০টায় একটি বাসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেন জাহাজের মাস্টার শামসুদ্দিন। পাঁচ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম পৌঁছানোর কথা। ওই দিন বেলা ২টায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এসে গাড়ি আর চলে না। দেখতে দেখতে শুক্রবার দিন ও রাত ওই স্থানে কেটে যায় তার। পরের দিন শনিবার সকালে ওই গাড়ি থেকে নেমে সিএনজি অটোরিকশা ও ছোট ছোট গাড়ি করে দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম এসে পৌঁছান তিনি। এই অভিজ্ঞতা শুধু শামসুদ্দিনের নয়, হাজার হাজার যাত্রীর।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছেড়ে আসা পণ্যবাহী ট্রাকের চালক সুজন জানান, ভোর রাতে ঢাকার নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বের হয়ে নিজামপুর এলে যানজটে পড়েন। এ যানজট কাটিয়ে বারইয়ারহাট পর্যন্ত আসতে ১৫ মিনিটের জায়গায় লেগেছে ৪ ঘণ্টা। ঢাকা পৌঁছতে ক’দিন লাগে তা তিনি নিশ্চিত নন বলে জানান।

এই বিষয়ে মিরসরাই থানার ওসি সাইরুল বলেন, অপ্রত্যাশিত এই যানজট নিরসনে হাইওয়ে পুলিশের সাথে জোরারগঞ্জ ও মিরসরাই থানার সব পুলিশ প্রতিটি ইউটার্নে অবস্থান নিয়ে যানজট নিরসনে কাজ করছেন। বিপ্তি সব গাড়িকে শৃঙ্খলায় রেখে আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে মহাসড়ক সচল করতে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, আশা করছি রাতের মধ্যেই পুরো মহাসড়ক সচল হয়ে যাবে। তিনি বলেন, বৃষ্টির কারণেও কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।
বারআউলিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্র্জ আহসান হাবিব বলেন, লরি ও ট্রাকচালকেরা যানজটের জন্য অনেকাংশে দায়ী। যানজট দেখলেই রাস্তার পাশে গাড়ি ফেলে সরে পড়েন চালক, এতে রাস্তা সঙ্কুচিত হয়ে যানজট তীব্রতা পাচ্ছে। উল্টো পথে গাড়ি চালানোও একটি বড় কারণ।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় যানজট নিরসনে বিভিন্ন স্থানে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, মহাসড়কের উভয় পাশ চওড়া করা, বাস বে নির্মাণের নির্দেশ দিলেও সওজ অধিদফতর এসব নির্দেশনাকে পাত্তা দিচ্ছে না। চার লেন হওয়ার পর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে গড়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগত। বর্তমানে কখনও কখনও ২০ ঘণ্টাও লেগে যাচ্ছে।
চাঁদাবাজির জন্য বড় দারোগারহাটে ওজন স্টেশনে যানজট লেগেই থাকে। আর ফেনীতে লেভেলক্রসিং থেকে উড়াল সেতু বা ওভারপাস নির্মাণ কাজের কারণে ১৩ দিন ধরে মহাসড়কে যানজটে যাত্রাভঙ্গ হচ্ছে যাত্রীদের।

ফেনীর পুরান সড়কটি গ্রামের ভাঙা সড়ককেও হার মানায় জানিয়ে প্রত্যদর্শী ও যাত্রী আমিনুল হক বলেন, এ সড়কের গর্তগুলো বড় বড়। গাড়ি চালানো মুশকিল। বাংলাদেশের বিস্ময়কর চালকরাই শুধু এমন সড়কে গাড়ি নিয়ে ছুটতে পারেন। ফতেহপুরে যেখানে ওভারপাস নির্মাণ চলছে, সেখানে সেনাবাহিনী এবং পুলিশ সদস্যরা দাঁড়িয়ে থেকে সুষ্ঠুভাবে তদারকি করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, কেন এই নির্মাণকাজ শুরু আগে বিকল্প ব্যবস্থার কথা মাথায় রাখা হয়নি? প্রস্তুতি হিসেবে ফেনীর পুরনো সড়কটি তো মেরামত করে রাখা যেত!
এই আপদকালীন ট্রেনের বাড়তি ব্যবস্থাও রাখা যেত। আন্তঃনগর ট্রেনগুলো ফেনী ও মিরসরাইয়ের চিনকি আস্তানা স্টেশনে মিনিট দুয়েক বিরতি দিতে পারত।
সওজ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান বলেন, আমরা যানজট নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। উন্নয়ন কাজের জন্য যে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে তা নয়, দুর্ঘটনার জন্যও যানজট সৃষ্টি হয়ে থাকে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ক্রমান্বয়ে মানা হবে বলে তিনি জানান।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/318036