১৩ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:২৬

ব্যাংকিং খাতে বেনামি ঋণে বাড়ছে ঝুঁকি

নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। যখন ব্যাংকের পাওনা আদায় করতে পারছে না তখন সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে কারসাজির ঘটনা। ঋণের বিপরীতে যেসব সম্পদ বন্ধক রাখা হচ্ছে তার বেশির ভাগ কাগজপত্রই ভুয়া বা খাসজমি। অথচ এসব ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগীরা থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংকসহ বিভিন্ন ঋণ কেলেঙ্কারির অর্থ আদায় হচ্ছে না। মূলধন ঘাটতির মুখে পড়ছে ব্যাংকগুলো। সরকারি ব্যাংকগুলোতে এসব অনিয়মের দায় জনগণের অর্থ দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলো পড়ে যাচ্ছে বিপদে। যদিও সম্প্রতি ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির দায় মেটাতে সরকারি পাঁচটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার তহবিল জোগান দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এভাবে বেনামি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, কোনো কোনো ব্যাংকের এমডিরা অসহায়। তারা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। পরিচালকেরা যেভাবে করতে বলেন তাই করতে হয়। অন্যথায় এমডির পদ হারানোর আশঙ্কা থাকে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের এমডিরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন।

অপর একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, পরিচালকেরা বেশির ভাগ সময়ই ভাগাভাগি করে ঋণ বিতরণ করেন। যেমন এক ব্যাংকের পরিচালকেরা অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। আবার অন্য ব্যাংকের পরিচালকেরা ঋন নেন আরেক ব্যাংক থেকে। এভাবে ভাগাভাগির মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণ আদায় হয় না। বেশির ভাগ সময় ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই এসব ঋণ নবায়ন করা হয়। আবার নতুন ঋণ সৃষ্টি করে পুরনো ঋণ আদায় দেখানো হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে পৌনে দুই লাখ কোটি টাকাই চলে গেছে ব্যাংক পরিচালকদের দখলে। আর ২৯টি ব্যাংকের পরিচালকেরা নিয়েছেন নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা পরিশোধ করছেন না। এভাবেই ব্যাংকের পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে ভাগবাঁটোয়ারার ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, তার ব্যাংকের ঋণের একটি বড় অংশই পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ। আর এসব ঋণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খেলাপি হয়ে পড়েছে। কিন্তু কিছু বলা যাচ্ছে না। এভাবেই ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ২৯টি ব্যাংকের পরিচালকেরা তাদের নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, ৩৮৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। আর ৫৭টি ব্যাংক থেকে পরিচালকেরা ঋণ নিয়েছেন এক লাখ ৪৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা।
নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে নতুন ব্যাংকের পরিচালকেরা। এর মধ্যে মেঘনা ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালক নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ১০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মিডল্যান্ড ব্যাংক থেকে ১৮ কোটি টাকা, মধুমতি ব্যাংক থেকে তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা, এনআরবি ব্যাংক থেকে দুই কোটি ১০ লাখ টাকা, সীমান্ত ব্যাংক থেকে ৩৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল ব্যাংক থেকে ৬৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন নিজ ব্যাংকের পরিচালকেরা।
পুরনো ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংক, আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, মিউচুয়্যাল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংকের কিছু কিছু পরিচালক তাদের নিজ নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন।

বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৫৩টি ব্যাংক থেকেই পরিচালকেরা ঋণ নিয়েছেন প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে নতুন ৯ ব্যাংকের সব ক’টি থেকেই পরিচালকেরা ঋণ নিয়েছেন। যেমনÑমেঘনা ব্যাংক থেকে প্রায় ৪২৮ কোটি টাকা, মিডল্যান্ড ব্যাংক থেকে ৩৫৩ কোটি টাকা, মধুমতি ব্যাংক থেকে ৪০২ কোটি টাকা, এনআরবি ব্যাংক থেকে ১৭৪ কোটি টাকা, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ৯৪৯ কোটি টাকা, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক থেকে ৬২১ কোটি টাকা, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক থেকে ৫৮৮ কোটি টাকা, দি ফারমার্স ব্যাংক থেকে ২০৮ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন অন্য ব্যাংকের পরিচালকেরা।
পাঁচ হাজার কোটি টাকার ওপরে পুরনো ব্যাংকগুলোর মধ্যে পরিচালকদের ঋণ রয়েছে ইসলামী ব্যাংকের ১১ হাজার ৯১০ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংকের ৯ হাজার ১০৬ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়ার ৫ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংকের ৫ হাজার ৫৩ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ৮ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৬ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র রয়েছে, এর বাইরেও রয়েছে নিজ ব্যাংক থেকে পরিচালকদের বেনামি ঋণ। এ কারণে ব্যাংকিং খাতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। ওই সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোর খেলাপিদের ঋণের একটি বড় অংশই বর্তমান ও সাবেক ব্যাংক পরিচালক, তাদের স্ত্রী-পুত্র-সন্তান বা তাদের নিকটাত্মীয়দের কাছে আটকা পড়ে আছে। এসব ঋণ প্রস্তাব, অনুমোদন ও বিতরণের প্রতিটি েেত্রই অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংকগুলোর পরিচালকের সংখ্যা এক হাজারের কাছাকাছি হলেও এ ধরনের সমঝোতাভিত্তিক বড় অঙ্কের ঋণ বিনিময় করেন শতাধিক পরিচালক। যাদের কয়েকজন বেশি বিতর্কিত। মূলত এদের কাছেই পুরো ব্যাংকিং সেক্টর জিম্মি হয়ে পড়েছে।

গত ৮ মে বিআইবিএমে এক কর্মশালায় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের এমডি মো: ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ব্যাংকিং খাতের স্বর্ণযুগ দেখেছি। এখন পার করছি কলিযুগ। তিনি বলেন, বেনামি ঋণ ঠেকাতে উদ্যোগ নিতে হবে। ঋণ দেয়ার আগে গ্রাহকদের ছয় মাসের ব্যাংক লেনদেন খতিয়ে দেখতে হবে। খেলাপি ঋণ মনিটরিংয়ে ডাটা ব্যাংক করতে হবে। গৃহঋণের বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা আইনজীবীরা জমিসংক্রান্ত অনেক তথ্য দেয়, যা সঠিক নয়। অবশ্যই সরেজমিন পরিদর্শন করে ঋণ দিতে হবে। একই অনুষ্ঠানে পূবালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হেলাল আহমদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংকের ঋণখেলাপি রেখে বিভিন্ন দেশে অনেকে বিজনেস কাসে ঘুরে বেড়ায়। গ্রাহকদের মানসিকতার পরিবর্তন হলে কোনো ঋণ খেলাপি হবে না। এতে খেলাপি ঋণ অনেকাংশে কমে আসবে। তিনি বলেন, নির্দিষ্ট এলাকায় ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। আবার একইভাবে নির্দিষ্ট লোককে ঋণ দিচ্ছে। এভাবে বাছ-বিচারহীন ঋণের কারণে একটি বড় অংশ ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াছিন আলি বলেন, কিছু ধূর্ত লোক তার একই সম্পত্তি বারবার দেখিয়ে ঋণ নেয়। এ বিষয়ে বার বার আলোচনা হয়েছে। বিষয়টিতে এখন নজর দেয়ার সময় এসেছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/318048