১৩ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:২৪

রিমান্ডে মৃত্যুর দায় কার?

ইকতেদার আহমেদ

‘রিমান্ড’ ইংরেজি শব্দ। এর বাংলা অর্থ হল পুনঃপ্রেরণ; তবে আমাদের আইনাঙ্গনে ইংরেজি রিমান্ড শব্দটি বহুল অর্থে ব্যবহৃত হয়। আইনাঙ্গনে রিমান্ড অর্থ বিচারিক আদেশের মাধ্যমে মামলা সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে পুলিশের হেফাজতে প্রদান।
সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধির বিধান অনুযায়ী পুলিশ কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে আটক করা হলে তাকে যাত্রা সময় ব্যতিরেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাছের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করতে হয়। আটক-পরবর্তী ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতিরেকে পুলিশ কোনো ব্যক্তিকে আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত সময়ের জন্য আটক রাখতে পারে না, যদিও আটকের সময় সংশ্লিষ্ট নিবন্ধন বইয়ে লিপিবদ্ধ না করার কারণে প্রায়ই এর ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়।

সচরাচর কোনো মামলায় সাক্ষ্যের অপ্রতুলতার কারণে প্রমাণজনিত জটিলতা পরিলক্ষিত হলে অতিরিক্ত প্রমাণাদি সংগ্রহের জন্য পুলিশ কর্তৃক আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডের আবেদন করা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির দুটি ধারার অধীন পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিমান্ডের আবেদন করে থাকে। এ ধারাগুলো হল ১৬৭ ও ৩৪৪। প্রথমোক্ত ধারাটিতে রিমান্ডের আবেদনের ক্ষেত্রে মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আটক-পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্তকার্য সম্পন্ন না হলে পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাজিস্ট্রেট সর্বোচ্চ একবারে ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারেন। এ ধারার অধীন রিমান্ডের ক্ষেত্রে পুলিশের হেফাজত থেকে মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আদালতে হাজির-পরবর্তী বিচারিক আদেশের মাধ্যমে পুনঃপুলিশের হেফাজতে নেয়া হয়। শেষোক্ত ধারার ক্ষেত্রে মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কারান্তরীণ থাকাবস্থায় পুলিশ কর্তৃক ম্যাজিস্ট্রেটের বরাবর রিমান্ডের আবেদন করা হয়। এ ধারাটির অধীনেও একজন ম্যাজিস্ট্রেট পূর্বের ধারাটির মতো একবারে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারেন। এ ধারাটির অধীন রিমান্ড মঞ্জুরকালে মামলার তদন্ত অথবা বিচার স্থগিত করা হয়। উভয় ধারার অধীন রিমান্ড মঞ্জুরের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক রিমান্ডের সময়কাল নির্ধারণ করে দেয়ার আবশ্যকতা রয়েছে।

আজ থেকে দু’যুগ আগে অত্যন্ত নগণ্য সংখ্যক মামলা সংশ্লেষে এক বা একাধিক ব্যক্তির জন্য রিমান্ডের আবেদন করা হতো এবং সে সময় রিমান্ড মঞ্জুরকালে এর সময়কাল নির্ধারণ বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেটরা খুব সতর্কতা অবলম্বন করতেন। সে সময় রিমান্ডের সময়কাল ১ বা ২ দিনের অধিক খুব কমই প্রত্যক্ষ করা গেছে। বর্তমানে পুলিশ কর্তৃক রিমান্ডের আবেদন করা হলে ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে কোনো ধরনের বাছবিচার ব্যতিরেকে ঢালাওভাবে তা মঞ্জুরের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতই মামলা প্রমাণার্থে অতিরিক্ত সাক্ষ্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলে রিমান্ডের আবেদন ও তা মঞ্জুরে দোষের কিছু নেই; তবে বাছবিচার ব্যতিরেকে ঢালাওভাবে রিমান্ড মঞ্জুর ন্যায়বিচার ও নীতিনৈতিকতার পরিপন্থী।

বর্তমানে বিভিন্ন মামলা সংশ্লেষে যেসব ব্যক্তিকে রিমান্ডে নেয়া হয়, তাদের প্রায় সবাই পুলিশ কর্তৃক চরমভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন-হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। রিমান্ডে থাকাকালীন এবং রিমান্ড থেকে প্রত্যাবর্তন-পরবর্তী মৃত্যুর একাধিক ঘটনার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। রিমান্ড-পরবর্তী যখন মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পুনঃম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করা হয়, তখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুনঃরিমান্ডের আবেদন করা হয়, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে রিমান্ড সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠানোর জন্য আবেদন করা হয়। উভয় ক্ষেত্রে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য রিমান্ড সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা যাচাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে অত্যাবশ্যক হলেও তা খুব কমই অনুসৃত হয়।
সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান ও আইন মেনে চলা দেশের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। সংবিধান এবং আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো আইন মামলা সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি পুলিশের হেফাজতে রিমান্ডে থাকাকালীন শারীরিক নির্যাতন অনুমোদন করে না। এ বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৩৫(৫) প্রণিধানযোগ্য। এ অনুচ্ছেদটির দফা নং ৫-এ সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে- কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানসিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। আইন অনুযায়ী দণ্ড প্রদানের ক্ষমতা একমাত্র আদালতের ওপর ন্যস্ত। উপরোক্ত দফাটি অবলোকনে প্রতীয়মান হয় আদালত কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ডের মধ্যে যন্ত্রণা থাকতে পারবে না এবং সে দণ্ড নিষ্ঠুর, অমানসিক বা লাঞ্ছনাকর হবে না।
রিমান্ড থেকে প্রত্যাবর্তন-পরবর্তী রিমান্ড সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু এবং নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার অনেক ঘটনা গণমাধ্যমের সুবাদে দেশবাসী অবগত হয়েছে। রিমান্ড থেকে প্রত্যাবর্তন-পরবর্তী মৃত্যুর ক্ষেত্রে এবং রিমান্ডে থাকাকালীন শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হওয়া বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে দায় এড়ানোর দাবি করে বলা হয়, তাদের হেফাজতে থাকাকালীন মৃত্যু সংঘটিত না হওয়ায় এবং তারা তাদের দাবি মতে শারীরিকভাবে সক্ষম রিমান্ড-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করায় পরবর্তী সময়ে সংঘটিত মৃত্যু বা শারীরিক অক্ষমতা বা অসুস্থতার দায় তাদের নয়। পুলিশের এ ধরনের দাবি দ্বারা যে ন্যায়পরায়ণতা পরাভূত হয়, সে বিষয়ে কারও মধ্যে কোনো ধরনের সংশয় থাকার কথা নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- ডাকাতি সংঘটনকালে ডাকাতের ছুরিকাঘাতে বা গুলির আঘাতে গৃহস্বামী বা তার পরিবারের কোনো ব্যক্তি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে বিচারের জন্য সোপর্দকৃত ডাকাতের এ ধরনের ওজর গ্রহণের অবকাশ আছে কিনা যে, গৃহকর্তা বা তার পরিবারভুক্ত ব্যক্তি ডাকাতি সংঘটন-পরবর্তী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় এ মৃত্যুর দায় তার (ডাকাত) নয়। এ ধরনের ওজর যে আদালতের কাছে কখনও গ্রহণীয় হবে না, তা স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন যে কোনো সচেতন মানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম। সুতরাং এ ধরনের মৃত্যু বা শারীরিক অক্ষমতার সম্মুখীন হওয়া-পরবর্তী পুলিশের এরূপ ওজর কোনোভাবেই আইন এবং নীতিনৈতিকতার মানদণ্ডে গ্রহণীয় নয়।

১৯৮৪ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে নিউইয়র্কে নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দণ্ডবিরোধী একটি সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে সনদটিতে স্বাক্ষরদান করে। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৩৫(৫)-এর বিধান অনুযায়ী নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ বিধায় জাতিসংঘ সনদ ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে কার্যকর রূপ দেয়ার লক্ষ্যে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়।

২০১৩ সালে প্রণীত আইনটিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে মৃত্যুকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করে দণ্ড দেয়ার বিধান করা হয়েছে। আইনটিতে হেফাজতে মৃত্যুর যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘হেফাজতে মৃত্যু’ অর্থ সরকারি কোনো কর্মকর্তার হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু; এ ছাড়াও হেফাজতে মৃত্যু বলতে অবৈধ আটকাদেশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক গ্রেফতারকালে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুকেও নির্দেশ করবে; কোনো মামলায় সাক্ষী হোক বা না হোক জিজ্ঞাসাবাদকালে মৃত্যুও হেফাজতে মৃত্যুর অন্তর্ভুক্ত হবে। আইনটির ভাষ্য মতে ‘সরকারি কর্মকর্তা’ অর্থ- প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী অপরদিকে ‘সশস্ত্র বাহিনী’ অর্থ- সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী অথবা অপর কোনো রাষ্ট্রীয় ইউনিট, যা বাংলাদেশ প্রতিরক্ষার জন্য গঠিত। আইনটিতে প্রদত্ত ‘হেফাজতে মৃত্যু’-এর সংজ্ঞা পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, উক্ত সংজ্ঞায় সরকারি কর্মকর্তা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতকে অন্তর্ভুক্ত করলেও সশস্ত্র বাহিনীর হেফাজতকে অন্তর্ভুক্ত করে না।
এ আইনটি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, আইনটিতে নির্যাতনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করে মৃত্যু সংঘটনের জন্য অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং এর অতিরিক্ত ক্ষতিগ্রস্ত বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান রয়েছে। অপরদিকে শুধু নির্যাতনের ক্ষেত্রে অন্যূন ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং এর অতিরিক্ত ক্ষতিগ্রস্ত বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান রয়েছে।

আমাদের দণ্ডবিধিতে মৃত্যু সংঘটনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। মৃত্যু সংঘটনজনিত অপরাধের জন্য দণ্ডবিধির সাজার সঙ্গে এ আইনের সাজার পার্থক্য হল- দণ্ডবিধির অধীন অপরাধটি সংঘটিত হলে ন্যূনতম সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড পক্ষান্তরে এ আইনের অধীন অপরাধটি সংঘটিত হলে সাজা হল অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড। এ আইনটিতে ন্যূনতম সাজা নির্ধারণ করে দিয়ে সর্বোচ্চ সাজার উল্লেখ না থাকলেও সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড বারিত নয়। অনুরূপ অর্থদণ্ডের ক্ষেত্রেও অন্যূন ১ লাখ টাকা উল্লেখ থাকায় এর ঊর্ধ্বের যে কোনো অঙ্কের অর্থদণ্ড বারিত নয়।
রিমান্ডজনিত কারণে মৃত্যু ও নির্যাতন নিরোধকল্পে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ প্রণীত হলেও এ আইনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের পথে এখনও যে অনেক পথ পাড়ি দেয়া বাকি রয়েছে, তা রিমান্ড সংশ্লেষে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মৃত্যু ও নির্যাতনের প্রকাশিত সংবাদ অনুধাবনে অতি সহজেই অনুমেয়।
রিমান্ডে নেয়ার পর মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নির্যাতনজনিত কারণে মৃত্যু ঘটলে রিমান্ড আবেদনকারী পুলিশ কর্মকর্তা অথবা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না। তাছাড়া রিমান্ডের আদেশ প্রদানকারী ম্যাজিস্ট্রেটেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাই রিমান্ড মঞ্জুরের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্বশীলতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/48075