১৩ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:২২

বাংলাদেশ ফের একদলীয় শাসনের দিকে

চলতে ফিরতে দেখা

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

এখন বিশ্বব্যাপী সবাই জেনে গেছে যে, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিকব্যবস্থার বদলে ধীরে ধীরে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যতই স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার কথা বলুন না কেন, সেই চেতনার কোথায়ও দেশকে বিরোধী দলবিহীন কোনো স্বৈরতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন ছিল না। বরং স্বপ্ন ছিল একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার। সে স্বপ্ন এখন ধুলায় লুণ্ঠিত হয়ে গেছে। বাক, ব্যক্তি-স্বাধীনতা আজ পদদলিত। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। গুম আমাদের চার পাশে ভূতের মতো কালো কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেয়া হয়েছে দায়মুক্তি। তারা মানুষ ধরে ক্রস ফায়ারের নামে খুন করছে। গুম করছে। জিম্মি করে টাকা আদায় করছে। মাদকদ্রব্য ইয়াবার ব্যবসায় করছে। সব কিছুতেই দায়মুক্তি আছে বলেই মনে হয়। বিপন্ন নাগরিকেরা কেবলই চোখের অশ্রু ফেলছেন। প্রতিবাদ মানেই পৈশাচিক নির্যাতন। বিরোধী দলের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও বন্ধ হয়ে গেছে। বিশাল ওংকার বুকে নিয়ে দেশব্যাপী এক নৈঃশব্দ বিরাজ করছে। এ এক সর্বগ্রাসী ঝড়ের পূর্বাভাস।
বিএনপি চেয়ারপারসন ও দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ‘বিতর্কিত’ এক মামলায় নি¤œ আদালত পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। আর সরকারবিরোধীদের ওপর শাসক গোষ্ঠীর নির্বিচার দলন-পীড়ন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেকেই আশঙ্কা করছেন, আগামী নির্বাচন হবে ভয়ঙ্কর সঙ্ঘাতময়। এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল বর্জন করেছিল। আর আগামী নির্বাচন এ বছর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সম্প্রতি আলজাজিরা একটি রিপোর্ট করেছে। যার শিরোনাম ‘বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে’? টিভি চ্যানেলটি বলেছে, এখন সাধারণ আনুষের মনেও ব্যাপক উদ্বেগ রয়েছে যে, এই নির্বাচনের বছরে দেশে কী হতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ব্যাপকভাবে সরকারবিরোধীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
এদিকে জার্মানির সরকারি অর্থে পরিচালিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান (থিংকট্যাংক) বারটেলসমান ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে নতুন স্বৈরাচারী দেশ হিসেবে অভিহিত করেছে। বাংলাদেশ এই স্বৈরাচারী কাতারে লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া ও উগান্ডার সাথে রয়েছে। বারটেলসমান বলেছে, এই পাঁচটি দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে গণতন্ত্র ক্ষীয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। এখন আর এ সব দেশে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানও নেই। আলজাজিরার রিপোর্টে বারটেলসমানের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। আলজাজিরা আরও বলেছে, খালেদা জিয়ার বিতর্কিত গ্রেফতারের পর শেখ হাসিনার জন্য এটা বলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ এখন একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্র নয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও মনে করে, আওয়ামী লীগ ভিন্ন মতকে এমনভাবে দমন করছে, কেউই তাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহস করছে না। এ রকম পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন প্রক্রিয়া একটি অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। বেগম খালেদা জিয়াকে যদিও হাইকোর্ট জামিন মঞ্জুর করেছিলেন, কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে ‘কোনো কারণ না দেখিয়েই’ তার জামিন স্থগিত করে দেন আপিল বিভাগ।
এদিকে স্বৈরশাসকদের ক্ষেত্রে যা হয় বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটছে না। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রধানত নি¤œ আদালতকে বিরোধী দল ও ভিন্ন মত দলনের জন্য ব্যবহার করতে শুরু করেছে। সরকারের রোষানলে পড়ে দেশের প্রধান বিচারপতিকে বিদায় নিতে হয়েছে। শুধু বিদায় নয়, তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অধিকার গ্রুপগুলো ধারাবাহিকভাবে বলে যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫১৯ জনকে জোর করে গুম করা হয়েছে। ৩০০ জনের কোনো খবর নেই। তেমনি একজন মারুফ জামান। তিনি একটি সরকারবিরোধী পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছিলেন। আর সম্ভবত সে কারণেই গত ৪ ডিসেম্বর বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে তাকে অপহরণ করা হয়। মারুফ জামান কাতার এবং ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তাকে কে অপহরণ করল তা যেমন জানা যায়নি, তেমনি জানা যায়নি তিনি এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছেন। আর পরিস্থিতি বিবেচনা করে পুলিশ একপর্যায়ে মারুফ জামান সম্পর্কে তদন্ত থামিয়ে দেয় বলে আলজাজিরার কাছে অভিযোগ করেছেন তার মেয়ে শবনম জামান। এ বছর ১৩ মার্চ ছাত্রদল নেতা জাকির হোসেনকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। তারপর তাদের হেফাজতে জাকিরের মৃত্যু হয়। অভিযোগ আছে, পুলিশি নির্যাতনের ফলেই তিনি মারা যান। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রিপোর্ট করেছে, গত বছর বাংলাদেশ সরকার গোপনে সরকারবিরোধী শত শত লোককে আটক করেছে।
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। আলজাজিরা তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে এ রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিএনপির অভিযোগ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিল। জবাবে তিনি বলেছেন, বিরোধী দলগুলো তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চায় সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন। তার অর্থ আবার এই নয় যে, তাদের কর্মতৎপরতায় যদি সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয় পুলিশ সেটা চেক করতে পারবেন। আলজাজিরা ইনুকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল, ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বয়কট করেছিল এখনো আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, আগামী নির্বাচনেও নির্বাচনপ্রক্রিয়া একইভাবে বিঘিœত হবে। জবাবে ইনু বলেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হয়েছে। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং এখন তারা উপলব্ধি করতে পারছে যে, তাদের ওই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। বাংলাদেশ নব্য স্বৈরতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। জার্মান থিংকট্যাংকের এমন গবেষণাপত্রের জবাবে ইনু বলেন, থিংকট্যাংকের বক্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ভিত্তিহীন। তিনি বারটেলসমানের তথ্য-উপাত্ত দেখতে চান। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ ও মিডিয়াসহ খাঁটি গণতন্ত্রের সব শাখা বাংলাদেশে সম্পূর্ণ স্বাধীন। আওয়ামী নেতারা এভাবে কথা বলেছেন আলজাজিরার সাথে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, মিয়ানমারের জাতিগত নিধন কর্মসূচিতে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। যদিও সরকার কখনও স্বীকার করেনি যে, তারা বলপূর্বক কাউকে গুম করেছে। গাঙ্গুলি বলেছেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এবং মানবাধিকার কর্মীরা ভয়ের পরিবেশে কাজ করেন। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করায় অনেকে মামলা-মোকদ্দমার শিকার হয়েছে।
এদিকে সরকার প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ঢাকার রাজপথে কোনো সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দিচ্ছে না। যতবারই এই অনুমতি চাওয়া হয়, ততবারই সরকারের তরফ থেকে বলা হয় তাদের কাছে খবর আছে যে, বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দিলে তারা নাশকতামূলক তৎপরতা চালাবে। কিন্তু তার কোনো প্রমাণ তুলে ধরতে পারেনি। সব সময়ই পুলিশ তাদের অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছে। অথচ সরকারি দল ঢাকাসহ সারা দেশে সভা-সমাবেশ করছে এবং নির্বাচনের জন্য ভোট চাইছে, ভোটের প্রতিশ্রুতি আদায় করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, সরকার এবং সরকারি দল এটা মনে করছে যে, তারা কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন, গণতন্ত্রে এটা বিপজ্জনক বিষয়।

বারটেলসমানের রিপোর্ট সম্পর্কে হাস্যকর উক্তি করেছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। তাকে যখন রিপোর্ট সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তখন তিনি বলেন, কোথায় তারা এসব তথ্য পেল, কোন জরিপের ভিত্তিতে তারা এটা করেছে? বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে কাজ করে তারা এ ধরনের গবেষণার কথা কখনও শোনেনি। এ পরি প্রেক্ষিতে তিনি প্রশ্ন করেন যে, জার্মানদের কাছ থেকে আমরা কী ধারা শিখব, হিটলারের দেশ থেকে শিখতে হবে? তিনি এমনও দাবি করেন, ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচন সারা পৃথিবীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। নাগরিক অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে এইচ টি ইমাম বলেন, শুধু ঢাকা থেকেই তিন শতাধিক দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় এবং সরকার তাদের মত প্রকাশে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করে না। আওয়ামী লীগের আরেক শীর্ষ স্থানীয় নেতা আবদুল মতিন খসরু বলেন, বাংলাদেশ ১০০ ভাগ গণতন্ত্রের দেশ এবং এই গণতন্ত্রের মান সম্পর্কে প্রশ্ন করার কোনো অবকাশ নেই।

এ ছাড়া বাংলাদেশের দুর্নীতি এখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। ব্যাংকগুলো সরকারের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীদের কারণে ফোকলা হয়ে গেছে। কোনো কোনো ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার অবস্থা। এসব ব্যাংকও দেয়া হয়েছিল সরকারি লোকদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা সরকার কিছুতেই প্রকাশ হতে দিতে চাইছে না। সড়ক, সেতু ভবন নির্মাণে সরকারের ঘনিষ্ঠ ঠিকদারেরা রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার করছে। এ কাজ সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু তাদের কারো বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এমন শোনা যায়নি। দুর্নীতি দমন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তারা লোক দেখানোর জন্য সরকারি লোকদের ডেকে এনে বরং সনদপত্র দিয়ে দিচ্ছে যে, তিনি দুর্নীতিমুক্ত। এভাবেই দুদক দুর্নীতি ধোয়ার মেশিনে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নানারকম বক্তব্য দিলেও সরকারের তরফ থেকে তাতে কর্ণপাত করা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, আগামী নির্বাচনেও যেভাবে হোক জিততে হবে। তা না হলে যে টাকা বানিয়েছেন তা ভোগ করতে পারবেন না। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ কমিটি বলেছে যে, বাংলাদেশে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর শিকার হচ্ছে দরিদ্র সাধারণ মানুষ। তা ছাড়া সরকারি টাকা এমন সব লোকদের দেয়া হচ্ছে যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই এবং যাদের কাছ থেকে এই টাকা আদায় করা সম্ভব হবে না। এটা রোধ করার জন্য সরকারের তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেই। এখন বাংলাদেশে শাসনকার্যে স্বচ্ছতার দাবি সারা পৃথিবীতে বড় করে উঠেছে।
তবে এই যে সরকার একদলীয় শাসনের দিকে যাচ্ছে এটা সম্প্রতি শুরু হয়নি। এটা শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে যখন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়েছে, তখন থেকে। শেখ হাসিনা সরকার জানত যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করতে পারলে অন্য যারা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বে আসবে তাদের সবাইকে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করা এবং তার অনুগত করা সম্ভব। এখন বাংলাদেশে সেটাই ঘটছে। তবে সরকারকে স্মরণ রাখতে হবে, প্রত্যেক অ্যাকশনেরই রি-অ্যাকশন আছে। সব সময় সেটা আসার জন্য আমৃত্যু অপেক্ষা করে না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/317966