১২ মে ২০১৮, শনিবার, ১০:০৮

সিগন্যাল বাতি জ্বলে-নেভে গাড়ি চলে ইশারায়!

রাজধানীর চিত্র

রাজধানীর বিজয় সরণি উড়াল সেতুর তেজগাঁও ট্রাফিক সিগন্যাল প্রান্ত। একটি লোহার স্ট্যান্ডে মোট আটটি বাতি থাকার কথা, অথচ রয়েছে মাত্র দুটি। ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণে ব্যবহূত তিনটি বাতি। আর বাকি চারটির স্থান ফাঁকা। একই চিত্র নগরীর ব্যস্ততম সড়ক মালিবাগ-শান্তিনগর-কাকরাইল-গুলিস্তানের। তবে উল্টো চিত্রও চোখে পড়ে। কিছু ট্রাফিক সিগন্যাল পয়েন্টে দিন-রাতই জ্বলছে বাতি। চলে টাইম কাউন্টডাউন যন্ত্র।
কারওয়ান বাজরের সিগন্যাল পয়েন্টে দেখা যায়, সংকেত বাতিতে লাল আলো জ্বলে থাকলেও এগিয়ে চলেছে গাড়ির সারি। অন্যদিকে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যকে। গাড়ির চালক বা ট্রাফিক পুলিশ কেউই খেয়াল রাখছেন না সিগন্যাল বাতির দিকে। লাল-হলুদ-সবুজ যে বাতিই জ্বলুক না কেন, গাড়িচালকরা অপেক্ষায় থাকছেন ট্রাফিক সদস্যদের হাত উঁচিয়ে সংকেত দেওয়ার দিকে।

সংশ্নিষ্টদের মতে, ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী প্রায় ১২ লাখ গাড়ি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে হাতের ইশারাতেই। ঢাকার যানজট নিরসনে সরকার একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করলেও সমন্বয়হীনতার অভাবে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ প্রজেক্টের কর্মকর্তাদের বেতন বাদে রাজধানীর ৭০টি সিগন্যাল পয়েন্টের বাতির বিদ্যুৎ খরচ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি বছর খরচ হয় প্রায় ৮০ লাখ টাকা, যা সিটি করপোরেশনকেই বহন করতে হয়। অথচ কোনো সুফলই পাচ্ছে না নগরবাসী। ফলে দিন দিন রাজধানীর যানজট অসহনীয়ভাবে বাড়ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যানজট নিরসনে ২০০১-০২ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে 'ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট' প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর ৫৯টি সড়কের ৭০টি মোড়ে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসানো হয়। এর মধ্যে ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগে ৩৪, পূর্ব বিভাগে ১২, উত্তরে ১১টি এবং পশ্চিমে ১৩টি ট্রাফিক সিগন্যাল রয়েছে। ২০০৯ সালের ২২ নভেম্বর এগুলো
আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়। তবে অল্প দিনের মধ্যেই তা শিথিল হয়ে যায়। আবার শুরু হয় হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ। অন্যদিকে,
চালু হওয়ার মাত্র দু'বছরের মাথায় একে একে বিকল হয়ে পড়তে থাকে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থা।
রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি গাড়ি চলাচল করে রাজধানীর রাস্তাঘাটে। অন্যদিকে মানুষের মধ্যে সিগন্যাল দেখে চলা বা আইন মানার প্রবণতা নেই। তাই বাধ্য হয়েই হাতের ইশারায় সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি প্রজেক্টের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বলেই তারা কাজ করে যাচ্ছেন। সিগন্যালে সেটা অনুসরণ না করলে শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের।

তেজগাঁও মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক কনস্টেবল সিরাজ বলেন, রাজধানীর অন্যান্য স্থানের মতো এখানকার অবস্থাও করুণ। তিনটি বাতি ঝুলন্ত অবস্থায় থাকলেও যে কোনো সময় উধাও হয়ে যেতে পারে। তবে সচল বা অচল যাই হোক, এগুলোর ব্যবহার নেই। তাই ট্রাফিক পুলিশের ম্যানুয়াল অপারেটিং তথা হাত উঁচিয়েই চলছে গাড়ি নিয়ন্ত্রণের কাজ।
মনজিল পরিবহনের চালক মো. আলমগীর বলেন, 'ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তবে বাতি থাকলে দূর থেকে দেখতে পারতাম।' এ গাড়ির যাত্রী ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন বলেন, সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণে বাতি ব্যবহূত হলে অনেক সময় দুর্ঘটনা থেকেও রক্ষা পাওয়া সম্ভব হতো। কিন্তু বাংলাদেশে এ অবস্থা কবে চালু হবে। এই আধুনিক যুগেও ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় চলতে হয়। ফলে কোনো কোনো রাস্তায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট সিগন্যালেই বসে থাকতে হয়।
এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম সমকালকে বলেন, প্ল্যানিং, ইঞ্জিনিয়ারিং, এডুকেশন ও এনফোর্সমেন্ট- এ চার ভাগে ট্রাফিকের কাজ হয়। এর মধ্যে প্রথম তিনটি ভাগ পরিচালনা করে ঢাকা সিটি করপোরেশন। এনফোর্সমেন্টের কাজটা শুধু পুলিশ করে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে হয়তো চারজন ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এই চারজনের পক্ষে যতগুলো গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তার চেয়ে অনেক বেশি গাড়ি চলাচল করে ঢাকার রাস্তায়। সেক্ষেত্রে যানজট নিয়ন্ত্রণে পুরনো পদ্ধতিতে ফিরতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। কারণ আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে আইন মানার প্রবণতা নেই। প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় না আনতে পারলে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে না বলেও মত দেন তিনি।
রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সিগন্যাল মনিটরিংয়ের জন্য সচিবালয়ের পাশে আবদুল গনি রোডে গড়ে তোলা হয়েছিল নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। ওই নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ডিজিটাল ট্রাফিক ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের কথা থাকলেও তার প্রতিফলন নেই। রাজধানীর সব গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও সিগন্যাল পয়েন্টে আগের মতোই ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা হাতের ইশারা আর বাঁশি ফুঁকে নিয়ন্ত্রণ করছেন যানবাহন। কোথাও কোথাও ট্রাফিক পুলিশকে রশি দিয়েও যানবাহন আটকাতে দেখা যাচ্ছে।

ডিএসসিসির ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ প্রজেক্টের পরিচালক প্রকৌশলী মো. সোহাব উল্লাহ বলেন, স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের ট্রাফিক ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করছি। এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ ও সিটি করপোরেশন যৌথভাবে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করি ধীরে ধীরে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবো।
উত্তর সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুর রহমান সমকালকে বলেন, 'ট্রাফিক সিগন্যালের বাতিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করে টেকনিক্যাল বিভাগের লোকজন। এ বিষয়ে আমাদের বিভাগ অবগত নয়।'

 

http://samakal.com/capital/article/1805664