১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:১৬

হানাহানি করছে সরকারদলীয়রা ধরপাকড়ের শিকার বিরোধীরা

সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে চলেছেন সরকার সমর্থক নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। আর অবিরাম ধরপাকড়ের শিকার হচ্ছেন বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীরা।
দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই আইন-শৃঙ্খলার অবনতির জন্য প্রধানত দায়ী। এর জেরে আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ে হানাহানি চরমে উঠলেও সরকার যেন উদাসীন। এসব সংঘাতে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ঘটে। কিন্তু এসব অস্ত্র উদ্ধারে কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি। কিন্তু বিপরীতে কখনো গোপন বৈঠকের অজুহাত, কখনো নাশকতার ‘পরিকল্পনা’র অভিযোগ কিংবা বিনা অনুমতিতে একত্রিত হওয়ার বাহানা প্রভৃতি আন্দাজ-অনুমান-ধারণার ভিত্তিতে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। আটক করে অনেককে পুরনো মামলায় অথবা নতুন মামলা সৃষ্টি করে আটক রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি বা কার্যক্রম না থাকলেও দেশের কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই আটক- গ্রেফতারের ঘটনা অব্যাহত আছে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত কয়েক সপ্তাহে সরকার সমর্থক সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্বে বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী হত্যার শিকার হয়, আহত হয় অনেকেই। বিশেষ করে ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বে সৃষ্ট সংঘর্ষ-সংঘাত নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সংঘাতের অন্যতম কারণ নিজেদের ভেতরের প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করে কোথাও হল দখল-সিট দখল করা, কোথাও জলমহাল, বালুমহাল, ঠিকাদারি ও মাদকের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ এবং কোনখানে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এসব লড়াই-সংঘাত চলছে। এর আগে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি লোমহর্ষক ঘটনা সংঘটিত হয় আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরোধের জের ধরেই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন, টাঙ্গাইলে মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা, ফেনীর উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক হত্যা। এর মধ্যে অত্যন্ত পৈশাচিক হত্যার ঘটনা ছিলো ২০১৪ সালের ২০ মে ফেনী শহরের জনাকীর্ণ সড়কে প্রকাশ্য কুপিয়ে ও গুলী করে হত্যার পর একরামুল হককে বহনকারী গাড়িতে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয়া। সরকার সমর্থক দু’টি পক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নরায়ণগঞ্জে সাত জনকে অপহরণ ও খুন করে লাশ নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনায় আদালতে অভিযুক্ত হন ৩৫ জন। সম্প্রতি একটি আদালতের রায়ে তাদের মধ্যে থেকে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। বাকি ৯ জনকে ৭ থেকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। গত বছর ৬ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলা আ’লীগ নেতা রকিবুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর সঙ্গে দলেরই একটি পক্ষ জড়িত বলে তদন্তে জানা গেছে।
অতি সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনার মধ্যে গত ২ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আ’লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় মাথায় গুলীবিদ্ধ সমকাল-এর শাহজাদপুর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম (শিমুল) পরদিন শুক্রবার মারা যান। ২ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে পাবনার ঈশ্বরদীতে যুবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এতে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুজন কর্মী গুলীবিদ্ধ এবং আরো দুজন ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়। এর আগে ১ ফেব্রুয়ারি রাতে খুন হন নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্রবিলা ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি প্রভাষ রায়। তাঁর স্ত্রী টুটুল রানীর অভিযোগ, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আ’লীগের মনোনীত প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরোধের জের ধরে তাঁর স্বামীকে হত্যা করা হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর রেয়াজউদ্দিন বাজারে একটি হোটেলে ভাত খাওয়ার সময় প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারায় সরকারি সিটি কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী ইয়াছিন আরাফাত। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে আলোচিত হচ্ছে। এতে আহত হয় হারুনুর রশীদ (২৪) ও ইরফান রানা (২২) নামে আরো দুই যুবক। গত ১৩ মাসে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কেন্দ্র করে অন্তত ২৫ বার সংঘর্ষ হয়েছে। এসব ঘটনায় খুন হয় তিনজন। আহত হয় অন্তত ৬৫ জন। এর আগে গত বছরের ২৯ মার্চ চট্টগ্রামে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াসা ক্যাম্পাসে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হয় আরেক ছাত্রলীগ নেতা নাসিম আহমেদ।
এবছর ১৭ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় একটি জলমহালের দখলকে কেন্দ্র করে আ’লীগ ও যুবলীগের দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গুলীবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় ৩ জন। আহত হয় আরো ২২ জন। আগের দিন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে বড়মাছুয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও ইউপি সদস্য কাইউম হোসেনকে কুপিয়ে জখম করে প্রতিপক্ষের লোকজন। গত বছরের জুলাইয়ে খুলনায় ও কুমিল্লায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে প্রথক তিনটি ঘটনায় ছাত্রলীগের তিন নেতা-কর্মী খুন হয়। ১৯ নবেম্বর স্থানীয় ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আ’লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ। পরদিন নিজ বাসায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁর স্বজনদের অভিযোগ, হত্যার পর তাঁকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই ঘটনার পেছনেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখছেন নিহতের পরিবার ও আ’লীগের নেতারা। বছরের শেষদিন খুলনা মহানগর আ’লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জেড এ মাহমুদকে লক্ষ্য করে গুলী করে তাঁর প্রতিপক্ষরা। গুলী লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নিহত হন এক পথচারী নারী। জেড এ মাহমুদ অভিযোগ করেন, মাদক ব্যবসার বিরোধিতা করায় তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এর আগে ৩১ জুলাই খুলনায় ছাত্রলীগের নেতা সৈকত রোহানকে খুন করে প্রতিপক্ষ। ১৭ জুলাই একই গ্রুপের সদস্য আল আমিন ওরফে তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। স্থানীয় পুলিশ বলছে, এই পলাশ-রোহান গ্রুপ শহরের একটা অংশে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত। গত বছর মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে সারা দেশে সহিংসতায় নিহত হন ১১৬ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থক ৭১ জন, যাঁরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে প্রাণ হারান। একটি বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে রাজনৈতিক সংঘাতে দেশে ১৭৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে ৮৩ জন ক্ষমতাসীন আ’লীগের। খোদ কোন কোন আওয়ামী লীগ নেতাই স্বীকার করেন, বিরোধীরা মাঠে না থাকার কারণে এখন আ’লীগের প্রতিপক্ষ আ’লীগ নিজেই। ক্ষমতাসীন বলে তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও ভয় পায় না। এ জন্যই সংঘাত ও সহিংসতা বেড়েছে। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের পেছনেও অবৈধ অর্থ উপার্জন ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয় আলোচিত হয়েছে। এমনকি সর্বশেষ গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সাংসদ মনজুরুল ইসলাম লিটনের হত্যার পেছনেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের অভিযোগ রয়েছে। যদিও এজন্য কেবল রাজনৈতিক সন্দেহের ভিত্তিতে বিরোধীজোটের লোকদের জেলে ঢোকানো হচ্ছে।
ধরপাকড়ের শিকার বিরোধীরা : সরকার সমর্থক নেতা-কর্মী-সমর্থকরা দেশজুড়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে চললেও অবিরাম ধরপাকড়ের শিকার হচ্ছেন বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীরা। গত কয়েক মাসে বহু সংখ্যক বিরোধী নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করার ঘটনা জানা গেছে। সর্বশেষ এধরনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, গত ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মোহাম্মদপুরের এক বাড়ি থেকে জামায়াতের ২৮ জন পর্দানশীন নারীকে আটক করে রিমান্ডে নিয়ে অতঃপর জেলে পাঠানো হয়। পুলিশের অভিযোগ, আটক করা জামায়াতের ২৮ জন নারী সদস্য নাশকতা ও সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করছিল। পুলিশের তেজগাঁ বিভাগের ডিসি বিপ্লব কুমার সরকারের নেতৃত্বে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তবে, গ্রেফতারকৃতদের পক্ষের আইনজীবী এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, গ্রেফতারকৃতরা সবাই মোহাম্মদপুরের ঐ বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন। যে অভিযোগে তাদের ধরা হয়েছে তার পুরোটাকেই সাজানো ঘটনা বলে তিনি বর্ণনা করেন। এর আগে গত বছর ২৩ ডিসেম্বর মাগুরায় একটি মাদরাসা থেকে জামায়াতের ১৯ নেতা-কর্মীকে আটক করে পুলিশ। তাদের দাবি, নাশকতার জন্য তারা সেখানো জড়ো হয়েছিলো। গত বছর ৫ ডিসেম্বর নীলফামারীর জলঢাকায় জামায়াতের উপজেলা আমীরসহ পাঁচজন নেতা-কর্মীকে আটক করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, তারা সেখানে বৈঠক করছিলেন। ২১ ডিসেম্বর শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে উসকানি দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে সাভার উপজেলা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান উর্মি আক্তারসহ বিএনপি’র ১২ জনকে আটক করা হয়। ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে আটক করা হয় শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের ১০ নেতা-কর্মীকে। রমনা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের একটি মামলায় এদেরকে গ্রেফতার দেখানো হয়। তাদের বিরুদ্ধে বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের উস্কানি দেয়ার অভিযোগ আনা হয়। এবছর ১২ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে এক ইউপি সদস্যসহ জামায়াতের ৭ নেতা-কর্মীকে আটক করে পুলিশ। বুধবার সন্ধ্যায় উপজেলার চৌডালা ইউনিয়নের দক্ষিন হাউসনগর গ্রাম থেকে তাদের আটক করা হয়। ২০ জানুয়ারি গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ অভিযান বিএনপি-জামায়াতের ৩৮ নেতাকর্মীসহ ৫২ জনকে আটক করে পুলিশ। পঞ্চগড়ে জামায়াত-শিবিরের ৭ নেতা-কর্মীকে আটক করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে কিছু ইসলামী বইপত্র আটক করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে ইসলামী সমাজ নামের একটি সংগঠনের ২৪ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। এই সংগঠনটি পুলিশের ‘কালো তালিকাভুক্ত’ বলে জানানো হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে একটি মাদরাসা থেকে জামায়াত-শিবিরের চার নেতা কর্মীকে আটক করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, তারা নাশকতার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছিল। এভাবে প্রতিদিনই ২/৪ জন করে বিরোধী নেতা-কর্মী আটক হয়ে চলেছেন বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়।
http://www.dailysangram.com/post/271714-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A6%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A7%9F%E0%A6%B0%E0%A6%BE-%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%9C%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A7