১২ মে ২০১৮, শনিবার, ৯:৫০

রাজধানীতে হঠাৎ বেড়েছে খুনাখুনি

রাজধানীতে হঠাৎ বেড়েছে খুনাখুনি। ঘটছে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। তুচ্ছ কারণেই হচ্ছে মানুষ খুন। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর খুনের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও কলহ এর কারণ। পৈশাচিক কায়দায়ও করা হয় হত্যা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্যানুযায়ী রাজধানীতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ৭০টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। জানুয়ারি মাসে ১৩টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৬টি, মার্চ মাসে ২৩টি, এপ্রিল মাসে ১৮টি। প্রত্যেকটি ঘটনায়ই মামলা করা হয়েছে ডিএমপির বিভিন্ন থানায়। অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন সামাজিক অবক্ষয়, ইন্টারনেটের ভয়াবহতা, মাদকের ভয়াল বিস্তার, পারিবারিক সম্পর্কে ঘাটতির কারণে এসব ঘটনা বাড়ছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াতে বন্ধ হচ্ছে না অপরাধ। এ ছাড়া বরাবরই নির্বাচনকালীন বছরে দেশে অন্যরকম এক অস্থিরতা বিরাজ করে। তাই নির্বাচনের বছর এলে অপরাধীরা বেশি তৎপর হয়ে ওঠে।
এপ্রিল মাসের ১১ তারিখের ঘটনা। যাত্রবাড়ী থানার কুতুবখালী এলাকা। ব্যস্ত সড়কের পাশে পড়ে ছিল একটি ট্র্যাভেল ব্যাগ। দূরপাল্লার বাসের যাত্রীরা নামছেন আবার যাচ্ছেন। অনেকেরই নজর আসে ওই ব্যাগের দিকে। কিন্তু ব্যাগ নিয়ে কেউ এতটা আগ্রহ দেখান নি। সময় অনেক গড়িয়ে যাওয়ার পরও ব্যাগটি একই স্থানে পড়ে থাকে। আশপাশের মানুষের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। ব্যাগটি কার? কেনই বা এখানে ফেলে রাখা হয়েছে। অতীব কৌতূহল বশত এক পথচারী ব্যাগের চেইন খোলেন। তারপর তিনি চমকে উঠেন। কারণ ব্যাগের মধ্যে রয়েছে খণ্ডিত মরদেহ। খবর দেয়া হয় যাত্রাবাড়ী থানায়। পুলিশ এসে ব্যাগ উদ্ধার করে দেখতে পায় আনুমানিক ২২ বছর বয়সী কোনো তরুণীর মরদেহ। তারপর খণ্ডিত (শরীরের কোমর থেকে নিচের অংশ) মরদেহ পাঠানো হয় মর্গে। কুতুবখালী সড়কের দক্ষিণ পাসের ওই সড়কে সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ বেশ কিছু জেলার বাস যাত্রী উঠানামা করেন। আর সেখানেই কৌশলে দুর্বৃত্তরা মরদেহটি রেখে পালিয়ে যায়। সম্পূর্ণ ক্লু-লেস এই মরদেহ নিয়ে পুলিশ পড়েছে বিপাকে। তদন্ত কর্মকর্তারা তদন্তে নেমে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না। ঘটনাস্থলের আশপাশের সবক’টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। পুলিশ ধারণা করছে ঠান্ডা মাথার কিলার ছাড়া হত্যা করে আবার ধারালো ছুরি দিয়ে এ মরদেহ খণ্ডিত করতে পারে না। তার ঠিক পরের দিন ঘটেছে আরেক ঘটনা। খিলগাঁওয়ের বউ বাজার এলাকায় ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। ১৬ বছর বয়সী ওই যুবকের নাম রাসেল রনি। সে খিলগাঁও সরকারি স্টাফ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। পুলিশ জানায়, বউ বাজারের পুলিশ ফাঁড়ি মাঠে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছিল রনি। রাত আটটার দিকে খেলাটি শেষ হয়। খেলায় রনির দল বিজয়ী হয়। এ সময় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় আকাশ, সিরাজ, মাসুদসহ কয়েকজনের সঙ্গে রনির তর্ক হয়। একপর্যায়ে প্রতিপক্ষের সমর্থক রানা নামের এক কিশোর রনিকে ছুরি মেরে পালিয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় রনিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সে মারা যায়। এই ঘটনায় রনির পরিবারের পক্ষ থেকে খিলগাঁও থানায় একটি মামলা করা হয়। পরে পুলিশ হত্যাকাণ্ডে জড়িত কিশোরকে আটক করে।

চলতি সপ্তাহেই রাজধানীর দারুসসালামে শাহানা আলম খান বিউটি নামে এক নারীর হাত-পা বাঁধা ও মুখে স্কচটেপ পেঁচানো মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ৪৫ বছর বয়সী শাহানা ধানমন্ডির সানি ডাইল স্কুলের প্রধান হিসাব রক্ষক কর্মকর্তা ছিলেন। তার স্বামী কামাল হোসেন পুলিশের এএসআই পদে মাগুরা সদর থানায় কর্মরত। এই দম্পতি দারুসসালাম থানাধীন লালকুঠি তৃতীয় কলোনির ২৫২/১ নম্বর বাসায় থাকতেন। সেখানেই বিউটির বাবার বাসা হওয়াতে সবাই একসঙ্গে থাকতেন। শনিবার রাত ৭টার দিকে ওই বাসা থেকে পুলিশ বিউটির হাত-পা বাঁধা মরদেহ উদ্ধার করে। পুলিশ বলছে, হত্যাকাণ্ডের পরে নিহতের স্বামী বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে পারিবারিক কলহ ছিল। এর বাইরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিহত বিউটির সঙ্গে তার আপন ছোট বোনের পৈত্রিক সম্পতি নিয়ে বিরোধ ছিল। মূলত এ কারণেই এই ঘটনা ঘটতে পারে বলেও ধারণা করছে পুলিশ।
সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ জাতীয় নির্বাচনের বছর হওয়াতে অপরাধপ্রবণতা অনেক বেড়েছে। সময় যত যাবে অপরাধ আরো বাড়বে। কারণ এ সময় ঝিমিয়ে পড়া সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সজাগ হয়।

নেতাকর্মীরা তাদের প্রয়োজনে অপরাধীদের ব্যবহার করান। নির্বাচনকালীন সময়ে আধিপত্য বিস্তারের একটা বিষয় থাকে। এ সময় জেলে থাকা অপরাধীদের জামিনে বের করা হয়। সূত্র জানিয়েছে, দেশে এখন মাদকের ভয়াবহতা খুব বেড়েছে। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মাদক। আর এখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষই মাদকের সঙ্গে জড়িত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, বর্তমান সময়ের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণেই এসব ঘটনা গঠছে। রাজনৈতিক দিক দিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় গণতান্ত্রিক চর্চাটা খুব কম হচ্ছে। এর কারণে সব দলের মধ্যে একটা পাওয়া না পাওয়ার প্রবণতা রয়ে যায়। কে কার চেয়ে বেশি পেতে হবে। আমি কেন কম পেলাম। এ ধরনের কিছু বিষয় থেকে একটা রাজনৈতিক ক্ষোভ তৈরি হয়। আর এই ক্ষোভ থেকেই অপ্রীতিকর ঘটনা। এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, রাজনৈতিক ক্ষোভটা এতটা পৈশাচিক হচ্ছে খুনের পর মরদেহের উপরও সেই ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। বিকৃত করার পাশাপাশি অনেক সময় খণ্ডিত করা হয় মরদেহ। এর বাইরে সামাজিক কারণে ঘটে যাওয়া ঘটনারও কমতি নেই। সম্পত্তির জের, পরকীয়া, কলহ থেকে সামাজিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর কারণ হলো আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো তার দায়দায়িত্ব থেকে অনেক দূরে আছে। একটা সামাজিক বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে যা দরকার সেটা তারা করছে না। এজন্য মানুষের মধ্যে মানুষের দূরত্ব বাড়ছে। সমাজকল্যাণ বিভাগের এই শিক্ষক মনে করেন, সামাজিক চর্চাটা ভালোভাবে করা দরকার। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা দিয়ে হবে না। কারণ, তাদের তৎপরতা অপরাধ হওয়ার পর দেখা যায়। তবে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সামাজিক সংস্থাগুলোতে মানবিকতার চর্চা দরকার। তাহলেই আমারা একটি সুন্দর, সংঘাতবিহীন সমাজ পাবো।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপরাধ কমাতে সব সময় তৎপর থাকে। শুধু খুনের ব্যাপারে নয়। যেকোনো ধরনের অপরাধ মোকাবিলায় ডিএমপি তার সর্বোচ্চ দিতে চেষ্টা করে। আর বর্তমানে যতগুলো খুন হচ্ছে তার তদন্ত খুব দ্রুত শেষ করে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। অপরাধ করে কোনো অপরাধীই পার পাবে না।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=117001