১০ মে ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:১৩

স্কুলে পড়ালেখা কম, কোচিং বন্ধ, প্রাইভেটে হিমশিম

আরমান হোসেন চাকরি করেন একটি বেসরকারি কম্পানিতে। বেতন মাসে ২৮ হাজার টাকা।
এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর সংসার। ছেলে-মেয়ে দুজনই পড়ে মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে। বাসাও ওই এলাকায়। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘ছেলে পড়ে ক্লাস নাইনে, মেয়ে সিক্সে। স্কুলের পাশাপাশি দুজনই একটি কোচিং সেন্টারে পড়ত। মাসে দুজনের জন্য প্রয়োজন হতো তিন হাজার টাকা। বর্তমানে কোচিং বন্ধ থাকায় বাসায় টিচার রাখতে বাধ্য হয়েছি। স্কুলের পড়া যদি স্কুলেই বুঝিয়ে দেওয়া হতো, তাহলে কোচিংয়ের প্রয়োজন হতো না। এখন প্রাইভেট টিউটরের টাকা জোগাড় করতে আমাদের প্রচণ্ড হিমশিম খেতে হচ্ছে। ’

বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে নানা ছুটিছাঁটায় প্রায় অর্ধেক সময় বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সর্বোচ্চ ক্লাস হয় মাত্র ১৮০ দিন। আবার যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র পড়ে তাদের ক্লাস হয় আরো কম। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ক্লাসে অন্তত ১০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শ্রেণিশিক্ষক ক্লাসে এসে রোল কল করতেই চলে যায় দীর্ঘ সময়। অন্য শিক্ষকরা ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের ক্লাসে পড়া দিতে দিতেই সময় পার। সেখানে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আগের দিনের পড়া আদায় করা কিংবা পরের দিনের পড়া বুঝিয়ে দেওয়া অসম্ভব। যেমন—শিক্ষকরা গণিত ক্লাসে বড়জোর একটি-দুটি অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়ে বাকিগুলো বাড়িতে করতে বলেন। শিক্ষার্থীরা ক্লাসের পড়া কতটুকু বুঝল তা দেখার সময় থাকে না তাঁদের।

গত ২ এপ্রিল শুরু হয় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। চলবে আগামী ১৩ মে পর্যন্ত। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে গত ২৯ মার্চ থেকে পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে সব ধরনের কোচিং সেন্টার। পাবলিক পরীক্ষার সময় কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখায় বিপাকে পড়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। প্রাইভেট পড়াতে অনেক টাকা প্রয়োজন। এ কারণে বেশির ভাগ অভিভাবকের পক্ষে তাঁদের সন্তানদের গৃহশিক্ষক রেখে পড়ানো রীতিমতো অসম্ভব। যাঁরা বাধ্য হয়ে সন্তানদের প্রাইভেট পড়াচ্ছেন, তাঁদের অর্থ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাজমা আক্তার বলেন, ‘স্কুলে হয়তো সিলেবাস শেষ করে দেওয়া হয়, কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে না পড়িয়েই। আবার কোনো কোনো স্কুলে সিলেবাস শেষও করা হয় না। সব শিক্ষার্থীর মেধা তো সমান নয়! একই শ্রেণিকক্ষে একই শিক্ষকের কাছে সবাই সমানভাবে শিখতে পারে না। এর জন্য দরকার বাড়তি যত্ন। সব মিলিয়ে সন্তানদের নিয়ে আমাদের দৌড়াতেই হচ্ছে কোচিং-প্রাইভেটের পেছনে। ’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে আমাদের। শিক্ষকরা যদি দক্ষ হন; আর ক্লাসে মনোযোগী হন তাহলে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে আমরা নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। মেধাবীরাও শিক্ষকতা পেশায় আসতে শুরু করেছে। আশা করছি ভবিষ্যতে পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে। ’

সূত্র মতে, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ছায়া শিক্ষা (কোচিং ও সহায়ক গ্রন্থ) চালু রয়েছে। উন্নত দেশগুলোর শিক্ষার্থীরাও স্কুল-কলেজের পাশাপাশি কোচিং সেন্টার এবং সহায়ক গ্রন্থের সহায়তা নেয়। কিন্তু বাংলাদেশে ছায়া শিক্ষা নিয়ে অন্য চিন্তা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়ায় সব ধরনের কোচিং স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধের পাশাপাশি সহায়ক গ্রন্থও বন্ধের কথা বলা হয়েছে। দক্ষ শিক্ষক তৈরি না করে, স্কুলে লেখাপড়া শেষ করার ব্যবস্থা না করে কোচিং ও সহায়ক গ্রন্থ বন্ধ করা হলে শিক্ষাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সরকার পাবলিক পরীক্ষার সময় কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখলেও কিছু কোচিং সেন্টার আড়ালে-আবডালে শিক্ষার্থী পড়াচ্ছে। অবশ্য নামকরা কোচিং সেন্টারগুলো তাদের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। নামকরা কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী নিম্নমানের কোচিংয়ে পাঠ নিতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে কোনো চিন্তাভাবনা নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।
ছায়া শিক্ষার আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, উন্নত বিশ্বসহ সমগ্র বিশ্বে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ছায়া শিক্ষা নেই। আমাদের পাশের দেশ ভারতে ছায়া শিক্ষাকে স্বীকৃতি দিয়ে পৃথক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। উল্টো বাংলাদেশে ছায়া শিক্ষা বন্ধের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ১৯৮০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় একবার প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সে দেশের আদালত এটিকে শিক্ষা গ্রহণের বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। সিঙ্গাপুরে ২০১২ সালে রেজিস্টার্ড কোচিং সেন্টারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০টি। ২০১৫ সালে সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৮৫০টিতে দাঁড়িয়েছে। সেখানে প্রাথমিকের ৮০ শতাংশ, মাধ্যমিকের ৬০ শতাংশ এবং প্রাক-প্রাথমিকের ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী টিউশনের দ্বারস্থ হয়। জাপানের ২০০২ সালের তথ্যানুযায়ী পাবলিক এলিমেন্টারি স্কুলের ৩৯ শতাংশ, পাবলিক মিডল স্কুলের ৭৫ শতাংশ ও পাবলিক হাই স্কুলের ৩৮ শতাংশ আলাদা টিউশনের দ্বারস্থ হয়। হংকংয়ের ২০০৩ সালের তথ্যানুযায়ী, প্রাথমিক পর্যায়ে ৩৫ থেকে ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থী টিউশনের সাহায্য নেয়। মাধ্যমিকে এই হার আরো বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০০৮ সালের তথ্যানুযায়ী ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুলের বাইরেও প্রাইভেট বা কোচিংয়ের দ্বারস্থ হয়। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, তাইওয়ানসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা এখনো প্রাইভেট বা কোচিংয়ের সাহায্য নেয়।

বাংলাদেশেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে যারা ভর্তির সুযোগ পায়, তারাও কোনো না কোনো কোচিং সেন্টারের সহায়তায়ই ভর্তির প্রস্তুতি নেয়। এমনকি বিসিএসে উত্তীর্ণদের শীর্ষে যাঁরা রয়েছেন তাঁরাও কোচিং সেন্টার থেকে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন। এসব কোচিংয়ের কোনোটাই একাডেমিক কোচিং নয়। এদের সঙ্গে পাবলিক পরীক্ষার কোনো সম্পর্কও নেই।
কোচিং অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশের আহ্বায়ক ইমদাদুল হক (ই হক স্যার) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোচিং সেন্টার বন্ধ হলে উচ্চবিত্তের সমস্যা হবে না। সমস্যায় পড়বে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। একটি ভালো কোচিং সেন্টারে এক হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার টাকায় সব বিষয়ে পড়া যায়। সেখানে বুয়েট, মেডিক্যালের মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়ান। এর বিপরীতে প্রাইভেট পড়তে হলে প্রয়োজন কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ একটি মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে জোগাড় করা অসম্ভব। তবে কোচিংসংশ্লিষ্ট কেউ যদি প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকে আমরা তাদের কঠোর শাস্তি চাই। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রয়োজন বিবেচনা করে অন্যান্য দেশের মতো কোচিং সেন্টারগুলোকে ছায়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছি। ’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (মাধ্যমিক) সালমা জাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত সব কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে। এ নিয়ে কোচিং অ্যাসোসিয়েশনের যদি কোনো বক্তব্য থাকে, অফিশিয়ালি তারা আমাদের জানালে পরীক্ষার পর বিষয়টি নিয়ে ভাবা যেতে পারে। ’

 

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/05/10/634501