১০ মে ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:০০

ফেনীতে যানজটে প্রতিদিন শত কোটি টাকার লোকসান

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী বাইপাস অংশের ফতেহপুরে নির্মাণাধীন রেলওয়ে ওভারপাসের কারণে সৃষ্ট যানজটে প্রতিদিন কোটি টাকার বাণিজ্যিক ক্ষতি হচ্ছে। ঢাকার সাথে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ৬-৭ ঘণ্টার ক্ষেত্রে ১৫-১৬ ঘণ্টা এমনকি কোনো কোনো সময় তা ২০ ঘণ্টাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফেনী শহরের মহিপাল থেকে ফতেহপুর কিংবা মোহাম্মদ আলী থেকে মহিপাল ৬ কিলোমিটার পাড়ি দিতে ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগছে। এতে করে কেবল যাত্রীদের কর্মঘণ্টাই নষ্ট নয়, কোটি টাকার লোকসান গুনছেন পরিবহন মালিকেরাও।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১২ সালে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স শিপো পিবিএল ওভারপাসটি নির্মাণের দায়িত্ব পায়। একপর্যায়ে চাঁদাবাজির মুখে পড়ে তারা কাজটি শেষ না করে পালিয়ে যায়। দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশনকে ওভারপাসটি নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়। ৬০ কোটি ৫১ লাখ ১৮ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। ওভারপাসটি চালু হলে রাজধানী ঢাকা আর বন্দরনগরী চট্টগ্রামের গাড়িগুলো দ্রুত গন্তব্যে চলে যেতে পারবে। শহরের মহিপালে নির্মিত দেশের বৃহৎ ৬ লেনের ফাইওভারেরও সুফল মিলবে। ওভারপাস নির্মাণকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি মহাসড়ক যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে। এতে করে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের অন্তঃহীন দুর্ভোগের পাশাপাশি কাঁচামালসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য গন্তব্যে পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ায় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ঢাকা থেকে গার্মেন্ট পণ্যও যথাসময়ে বন্দরে পৌঁছতে না পারায় রফতানির শিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মহাসড়কে তিন হাজারেরও অধিক ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পণ্য আমদানি-রফতানি করে।

গত মঙ্গলবার দুপুরে ফতেহপুরে আটকে থাকা ঢাকাগামী কভার্ডভ্যানের (ঢাকা মেট্রো-ট-১১-৫৫৩৮) চালক ইমন জানান, চট্টগ্রাম থেকে সকাল ৮টায় মহিপাল পৌঁছেছি। মহিপাল থেকে ফতেহপুর পৌঁছতে ৬ ঘণ্টা সময় লেগেছে। এর আগে কয়েকদিন চট্টগ্রামগামী গাড়িগুলো কুমিল্লা দিয়ে লাকসাম, সোনাইমুড়ী হয়ে চৌমুহনী দিয়ে মহিপাল পার হয়েছে। এতে যাত্রীরা যেমন ভোগান্তির শিকার হয়েছে, তেমনি পরিবহন মালিকেরাও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন।
বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক ফেডারেশনের মহাসচিব আবু মোজাফফর জানান, ফতেহপুুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের কারণে কাঁচামাল পৌঁছতে দেরি হয়। ঢাকা থেকে শিল্প পণ্যও চট্টগ্রাম বন্দরে সময়মতো পৌঁছানো যায় না। কোনো দিন ৫-৬ ঘণ্টার যাতায়াতের পথে পুরো দিনও কেটে যায়। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকায় চালক-হেলপাররা শারীরিকভাবে অসুস্থ হচ্ছেন।
ফেনী জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি গোলাম নবী জানান, ফেনী থেকে ঢাকা রুটে মহাসড়কে বাস-ট্রাক-কাভার্ডভ্যানসহ শত শত গাড়ি চলাচল করে। এসব গাড়ির মালিককে দৈনিক অন্তত পাঁচ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।

স্টার লাইন গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক জাফর উদ্দিন নয়া দিগন্তকে জানান, যানজটের কারণে গাড়ির ট্রিপ কমে গেছে। অতিরিক্ত তেল, যান্ত্রিক খরচসহ চালক-হেলপার খরচও বেড়েছে। এক দিকে আয় কমলেও অন্য দিকে আগের চেয়ে গাড়ি প্রতি অন্তত ৬ হাজার টাকা খরচ বেড়ে গেছে।
ফেনী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান এ কে এম সাহেদ রেজা শিমুল জানান, ভয়াবহ যানজটের কথা শুনে তিনি ফেনী আসতে রেলের টিকিট কেটেছেন। অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ না করা গেলেও যানজটের ফলে প্রতি শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে বলে তিনি জানান।
মহাসড়কে প্রতিনিয়ত পণ্য আমদানি-রফতানি করে রাজধানীর এহসান গ্রুপ। কোম্পানির পরিচালক মো: এনামুল হক জানান, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি ভাড়া ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হতো। এখন তা বেড়ে ২৫ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত সোমবার ভোর ৪টায় ঢাকা থেকে পণ্য নিয়ে রওনা হয়ে মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় গাড়িটি বন্দরে পৌঁছায়।

জানতে চাইলে বিজিএমই সহসভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাসির নয়া দিগন্তকে বলেন, ওভারপাস নির্মাণকাজে যানজটের কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে নির্ধারিত সময়ে বন্দরে পৌঁছতে না পারলে ওই মালামাল ঢাকায় ফেরত পাঠিয়ে আবার বন্দরে পাঠাতে হয়। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি কোম্পানি বিষয়টি তাকে জানিয়েছেন।
এ দিকেও ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ ভয়াবহ এ যানজটে বিরামহীন পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এক পুলিশ সদস্য জানায়, বিকল্প সড়ক (ডাইভারশন) না করে ওভারপাস নির্মাণের কাজ করা যানজটের প্রধান কারণ। এ ছাড়া বিকল্প সড়ক পুরাতন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি ব্যবহার করলেও বর্তমানে সড়কটির অবস্থা খুবই নাজুক। ফলে ওই সড়ক দিয়েও যান চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
অপর দিকে ওই সড়ক দিয়ে শহরের উপর গাড়ি চলাচল করলে যানজটের প্রভাবে পুরো শহর অচল হয়ে পড়ে। দিনের বেলায় সাধারণত বিসিক শিল্প নগরী সড়ক দিয়ে গাড়িগুলো পার করা হয়। কিছুদিন ধরে গাড়ি চলায় ওই সড়কটিও খানা-খন্দে ভরে গেছে। এতে করে মহাসড়কের ফেনী বাইপাস অংশ এখন যাত্রী ও পরিবহনের কাছে অনেকটা আতঙ্কের নাম। বিষয়টি স্বীকার করে ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ মীর গোলাম ফারুক নয়া দিগন্তকে বলেন, যানজট নিরসনে পুলিশ সদস্যরা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন।

এ দিকে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি ফতেহপুর ওভারপাসের নির্মাণকাজ পরিদর্শনকালে বলেছিলেন, ‘ওভারপাসটির নির্মাণকাজ অর্ধেক শেষ হয়েছে। মে মাসে এটির অর্ধেক বা দুই লেন খুলে দেয়া হবে। তখন যানজট কমে যাবে।’

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/317176