৯ মে ২০১৮, বুধবার, ৮:১১

জটিলতায় কলেজের পাঠ্যবই

ক্লাস শুরু হতে প্রায় দু’মাস বাকি থাকলেও উচ্চমাধ্যমিকে পাঠ্যবই নিয়ে জটিলতা কাটেনি। এমসিকিউ থাকা না-থাকার ইস্যুটি এখন পর্যন্ত ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ। ফলে বেসরকারি প্রকাশকরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে নতুন শিক্ষাবর্ষের বই ছাপা শুরু করেননি। সরকারের তত্ত্বাবধানে থাকা বাংলা ও ইংরেজি বই নিয়েও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। এ দুটি বইয়ের বিষয়বস্তুর ওপর সম্প্রতি সারা দেশের শিক্ষকদের কাছ থেকে আসা মতামতের আলোকে উভয় বইয়ের গদ্য-পদ্য এবং রচনা পরিবর্তনের কথা। বিশেষ করে বাংলা বইয়ে বিদ্যমান কিছু গদ্য-পদ্য বাতিল করে নতুন পাঠ সংযোজনের বিষয় রয়েছে। ইংরেজি বইয়ের ওপরও একটি প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। ফলে সরকারি এ দুই বইয়ে পরিবর্তন আনার কথা। কিন্তু সবকিছু চলছে ধীরগতিতে। এ কারণে একাদশের শিক্ষার্থীদের যথাসময়ে পাঠ্যবই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সভা-সম্মেলনে এমসিকিউ বাতিলের কথা ওঠে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব পর্যায় থেকেও এমসিকিউ বাতিলের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। ফলে এমসিকিউ থাকবে কি না- এ নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের পাশাপাশি বই মুদ্রণকারীরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। সাধারণত কোনো সংযোজন-বিয়োজন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে হয়ে থাকে। ফলে আগামী জুলাইয়ে আসন্ন শিক্ষাবর্ষে উচ্চমাধ্যমিকে এমসিকিউ বাতিল হবে কি না- সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণার অপেক্ষায় সংশ্লিষ্টরা।
পাঠ্যবই ছাপিয়ে থাকে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ‘এমসিকিউ (নৈর্ব্যক্তিক) থাকবে না- এমন নির্দেশনা আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। তাছাড়া কোনো পদ্ধতি বাতিল বা সংযোজন দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। সে ধরনের কোনো প্রক্রিয়াও আমার জানামতে এখন পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। তাই এমসিকিউ থাকছে, এখন পর্যন্ত সেটা বলা যায়। সেই চিন্তা মাথায় রেখেই আমরা আগাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘বই সম্পর্কে শিক্ষকদের সুপারিশ আমাদের হাতে আছে। সেগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই কারিকুলাম বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে বিশ্লেষণ চলছে। আমাদের হাতে যে সময় আছে, তাতে হয়তো বিশ্লেষণ শেষে এবারই বাংলা-ইংরেজির নতুন বইয়ে পরিমার্জন আনা সম্ভব। যদি একান্তই কাজ শেষ না হয়, তাহলে আগের বই-ই আমরা ছাপতে দেব। তবে কী হচ্ছে, তা এখনও বলা যাচ্ছে না।’
প্রকাশকরা বলছেন, এনসিটিবি কোনো কিছু নির্দিষ্ট করে বলতে না পারায় এবার বই ছাপায় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ বছর এসএসসিতে ১৬ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছে। এসব শিক্ষার্থীর জন্য বেসরকারি প্রকাশকরা ২৯টি বিষয়ের বই ছেপে থাকেন। বাকি দুটি (বাংলা-ইংরেজি প্রথম পত্র) বিষয়ের বই সরকারের তত্ত্বাবধানে থাকলেও প্রকাশকরাই ছেপে বাজারজাত করেন। ফলে পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে এখনই সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত না হলে বই মুদ্রণ পিছিয়ে যাবে, ক্লাসের কার্যক্রমও বিঘ্নিত হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সাবেক সহসভাপতি ও পুঁথিনিলয় প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী শ্যামল পাল যুগান্তরকে বলেন, বেশি ধোঁয়াশা এমসিকিউ নিয়ে। পত্রপত্রিকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষপর্যায়কে উদ্ধৃত করে আমরা বক্তব্য দেখেছি। কিন্তু আসলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানা দরকার। বই ছাপানোর পর যদি টেলিফোনে পরিবর্তনের নির্দেশনা আসে, তাহলে প্রকাশকরা বিপাকে পড়বে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে এনসিটিবি থেকে কোনো দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় শুধু আমরাই (প্রকাশক) নই, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন।
বাংলা বই নিয়ে বেজায় আপত্তি : ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতি অনুযায়ী ২০১২ সালে নতুন কারিকুলাম তৈরি করে সরকার। তার আলোকে ২০১৪ সালে বাংলা প্রথমপত্র (পদ্য, পদ্য, উপন্যাস ও নাটক) এবং ২০১৫ সালে ইংরেজি প্রথমপত্র নতুন রূপে তৈরি করে পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা হয়।
সাধারণত কোনো বিষয়ে নতুন পাঠ্যবই প্রবর্তিত হলে তার ওপর ক্লাসে পাঠদানকারী শিক্ষকদের কাছ থেকে মতামত নেয়া হয়। এর নাম ‘ট্রাইআউট’। এ বছর দেশের নানা প্রান্তের শিক্ষকদের কাছ থেকে মতামত নিয়ে দুটি বিষয়ের ওপর করা আলাদা প্রতিবেদনে নানা সুপারিশ আছে। বাংলা বই নিয়ে রয়েছে সবচেয়ে বেশি আপত্তি।

সুপারিশে বলা হয়, বইটির নামকরণেই ভুল ধরা পড়েছে। বলা হয়েছে, এর নাম ‘সাহিত্য পাঠ’ না লিখে ‘সাহিত্যপাঠ’ লিখতে হবে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জসীমউদ্দীন এবং সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা বই থেকে বাদ দেয়ায় শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তারা মীর মশাররফ হোসেন, ফররুখ আহমদ এবং প্রমথ চৌধুরীর লেখাও পাঠ্যবইয়ে ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেছেন। এসব লেখক-সাহিত্যিকের রচনা বাদ দেয়ায় এনসিটিবির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের বিষোদ্গারের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও পাঠ্যগ্রন্থে কতিপয় লেখকের রচনা অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। তাদের মধ্যে অন্নদাশঙ্কর রায়, হুমায়ূন আহমেদ, বিহারীলাল চক্রবর্তী, ডিএল রায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। পাঠ্যগ্রন্থে নারী লেখকদের মাত্র দুটি রচনা রয়েছে, এটি লিঙ্গবৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে।

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর সিলেবাসকে অনেকে বৈচিত্র্যহীন বলেছেন। এতে গদ্যে মননশীল ও সুচিন্তিত প্রবন্ধের অভাব আছে। ‘জীবন ও বৃক্ষ’ প্রবন্ধের মতো একই মানের আরও প্রবন্ধ থাকা উচিত। বিশেষ করে প্রমথ চৌধুরী কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা অনেকে দেখতে চান। নৈতিকতা, দেশাত্মবোধ, মুক্ত ও উদার মানস গঠনের উপযোগী রচনার সন্নিবেশ থাকার পক্ষে জোরালো মত দেয়া হয়েছে। কবিতার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যহীনতার বিষয়টি অনেক বেশি। দুটি কবিতার নাম উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওইগুলো শিক্ষকদের তেমন টানে না। তিনটি কবিতা উল্লেখ করে বলা হয়, ওইগুলোর ভাববিষয় একই। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একালের ছেলেমেয়েদের কাছে উদ্ভট বিষয় বলে মনে হওয়ার মতো পাঠ আছে। ‘চাষার দুক্ষু’ সম্পর্কে বলা হয়, নামটি অস্বস্তিকর। কেননা চাষা শব্দটি আজকাল গালিবিশেষ। এতে নারীজাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার কোনো রচনা সংযোজনের সুপারিশ করা হয়।

এতে বলা হয়, পাঠ্যবইয়ে যৌতুকপ্রথাবিরোধী ‘অপরিচিতা’ পরিবর্তন করে হৈমন্তী অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। কেননা, ‘অপরিচিতা’য় জীবনে বিয়ে থেকে বিরত থাকার বার্তা আছে। এটা আদর্শ কোনো চেতনা নয়। প্রতিবেদনে কয়েকটি প্রবন্ধ-গল্পের বয়স উপযোগিতা নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘বায়ান্নর দিনগুলো’ শীর্ষক রচনায় ভাষাগত পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়েছে। ‘নেকলেস’ গল্পের বার্তা ভালো হলেও অনুবাদ দুর্বল বলে মত দিয়েছেন শিক্ষকরা। এতে ‘রেইনকোট’ গদ্যের পরিবর্তে ‘কলিমদ্দি দফাদার’ যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। নাম উল্লেখ করে কয়েকটি গল্প-কবিতা বাতিলের সুপারিশ আছে।
ভুলে ভরা বাংলা : প্রতিবেদনে বইয়ের ১৫৪টি পৃষ্ঠায় বানান, শব্দগঠন ও প্রয়োগে অসংখ্য ভুলভ্রান্তির কথা তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি ‘কার’ প্রয়োগ এবং বিদেশি শব্দের বানানে অভিন্নতা নষ্টের তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/46753