৮ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ১:০১

আঙুলের ছাপ-আইরিশ ছাড়াই মিলছে স্মার্ট এনআইডি কার্ড

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী চট্টগ্রামের এক বাসিন্দা জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য ২০১৫ সালের মার্চে চট্টগ্রামে আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে গিয়ে সব কাগজপত্র জমা দিয়ে ছবি তুলেছিলেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে আর দেশে আসেননি। অথচ তাঁর স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি কার্ড) চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস থেকে তুলে নিয়েছে অন্য একজন। এ ক্ষেত্রে নেওয়া হয়নি ওই প্রবাসীর ১০ আঙুলের ছাপ ও আইরিশ (চোখের স্ক্যানিং)। দালালদের সঙ্গে মিলে নির্বাচন অফিসেরই এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী অর্থের বিনিময়ে এ কাজে সহায়তা দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দালাল ও নির্বাচন অফিসের অসাধু কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী এই চক্র এরই মধ্যে কয়েক শ স্মার্ট এনআইডি কার্ড অর্থের বিনিময়ে বিতরণ করেছে দশ আঙুলের ছাপ ও আইরিশ ছাড়াই। ওই কার্ডগুলো ব্যবহার করে যেকোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করা সম্ভব বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং নির্বাচন অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বিষয়টিকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবেই দেখছেন তাঁরা।
নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর নাগরিক তথ্যসংবলিত উন্নত মানের জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্ট এনআইডি কার্ড দেওয়া শুরু হয় দেশজুড়ে। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ ৩৭ জেলায় স্মার্ট কার্ড বিতরণ কার্যক্রম চলছে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে জানা যায়, স্মার্ট এনআইডি কার্ডের জন্য দেশের ১০ কোটি নাগরিকের তথ্য নিয়ে একটি ডাটা বেইস তৈরি করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৯ কোটি নাগরিককে স্মার্ট এনআইডি কার্ড দেওয়ার কথা। এর মাধ্যমে বিদ্যমান পেপার লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র প্রতিস্থাপিত হবে।

স্মার্ট এনআইডি কার্ডে ৪১টি সেবার অপশন রাখা হলেও আপাতত ২৫টি সেবা সংরক্ষণ করা হয়েছে। তিন স্তরের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে কার্ডে।
কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ১০ আঙুলের ছাপ ও আইরিশ নিয়ে সংশ্লিষ্ট নাগরিককে স্মার্ট এনআইডি কার্ড দেওয়া হচ্ছে। জানা যায়, যেসব এলাকায় স্মার্ট কার্ড বিতরণের কাজ শেষ হয়েছে সেসব এলাকার অবিলিকৃত কার্ড আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের গোডাউনে জমা আছে। সেখানে নির্বাচন অফিসের সুনির্দিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্য কেউ ঢুকতে পারে না। কিন্তু নির্বাচন অফিসের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালচক্রের অপতৎপরতায় অর্থপাচার ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়নের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এবং সাধারণ জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য হুমকির মধ্যে পড়েছে।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা খুবই অ্যালার্মিং। এর ফলে সরকারের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। আর এটা শুধু নিরাপত্তার বিষয় নয়, এটা ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটিজ। যেহেতু বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সাংঘর্ষিক, তাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু অল্প কিছু টাকার লোভে তারা আঙুলের ছাপ আর আইরিশ ছাড়াই একজনের কার্ড আরেকজনকে দেওয়ার মতো গুরুতর অপরাধ করছে, এর চেয়ে বেশি টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে দেওয়া তাদের কাছে এমন কোনো কঠিন কাজ হবে না। সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এসব বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে।’
আড্ডা থেকে দালালের সন্ধান : মাস দেড়েক আগে নগরীর হালিশহরের এক আড্ডায় কথায় কথায় দশ আঙুলের ছাপ ও আইরিশ ছাড়া স্মার্ট এনআইডি কার্ড প্রাপ্তির প্রসঙ্গটি উঠে আসে। এরপর ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য প্রথমে দালাল হিসেবে কাজ করা নগরীর ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সুমনের মোবাইল ফোন নম্বর জোগাড় করে পরিচয় গোপন রেখে যোগাযোগ করা হয়ে। তাকে বলা হয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এক প্রবাসী আত্মীয়র ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত প্রয়োজনে জরুরি ভিত্তিতে স্মার্ট এনআইডি কার্ড বের করতে হবে। সুমন সে জন্য তিন কার্যদিবস সময় এবং দেড় হাজার টাকা দাবি করে। কিন্তু এক মাস পেরিয়ে গেলেও তার আর কোনো সাড়া না পেয়ে গত ২৪ এপ্রিল আবার যোগাযোগ করা হয়। সুমন এবার দুই হাজার টাকা দাবি করে। তাতে রাজি হওয়ায় গত ৩ মে সংশ্লিষ্ট প্রবাসী আত্মীয়র স্মার্ট কার্ডটি নিয়ে আসে সুমন। নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের দিয়ে যাচাই করে কার্ডটির মৌলিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে এই কার্ডে প্রকৃত মালিকের আঙুলের ছাপ ও আইরিশ নেই।

সুমন চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলে, ‘যেসব এলাকায় স্মার্ট কার্ড বিতরণ শেষ হয়েছে কিংবা বিতরণ কার্যক্রম চলমান, সেসব এলাকার যে কারো অরিজিনাল স্মার্ট আইডি কার্ড তুলে ঘরে পৌঁছে দেব। এরই মধ্যে ৩০-৩৫ জনের স্মার্ট এনআইডি কার্ড এভাবে দিয়েছি।’ চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করেই কার্ড বের করা হচ্ছে বলে সে জানায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আঙুলের ছাপ ও আইরিশ ছাড়া স্মার্ট আইডি কার্ড পাওয়ার মূল ভরসা দালাল। বিভিন্ন ওয়ার্ডে স্মার্ট আইডি কার্ড বিতরণের ক্যাম্পেইন চলাকালে সেখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে গিয়েই নির্বাচন অফিসের কম্পিউটার অপারেটরদের সঙ্গে সখ্য হয় ওই দালালদের। আর্থিক অবস্থা ও প্রয়োজন বুঝে প্রতিটি কার্ডের জন্য দেড় হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা দাবি করে তারা সময় নেয় তিন কার্যদিবস। এরপর সংশ্লিষ্ট নাগরিকের আগের কার্ডের ফটোকপি কিংবা ভোটার ফরম পূরণ করার পর দেওয়া কোড নম্বর ধরে নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে আইডি কার্ড বের করা হয়।

ইসির এনআইডি উইংয়ের পরিচালক (অপারেশন) মো. আব্দুল বাতেন গত শনিবার পুরো বিষয়টি শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘এটা তো ভয়ংকর ব্যাপার। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্মার্ট কার্ড প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে মানি লন্ডারিং, অ্যান্টি টেররিজম ফান্ডিংয়ের মতো সিরিয়াস ইস্যুগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য। এখন সেটাকেও যদি এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়!’ তিনি বলেন, ‘বাইরের কেউ এত সাহস করার কথা না। এর সঙ্গে থানা কিংবা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিচের দিকে সবাই জড়িত। আমরা অবশ্যই এটা তদন্ত করব। কিভাবে এবং কতটি কার্ড এভাবে দেওয়া হয়েছে সেটার খোঁজ নেওয়া সম্ভব। প্রয়োজনে চট্টগ্রামে টিম পাঠিয়ে যাচাই-বাছাই করব।’
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মনির হোসেন খান গত রবিবার প্রথমে তেমন গুরুত্ব দেননি। পরে আঙুলের ছাপ ও আইরিশ ছাড়া স্মার্ট কার্ড দেখে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন প্রায় ৮০০ কার্ড গোডাউন থেকে বের করা হচ্ছে। এর সাথে যদি দুটি বাড়তি কার্ড বের করা হয় সেটা সহজে ধরা পড়বে না। তার পরও আমি নিজেই তদন্ত করব।’


 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/05/08/633666