৮ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ১:০০

প্রাণ হারাচ্ছেন শত শত যাত্রী

মহাসড়কের পাশে সরকার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেগুলোতে রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্র না থাকায়

জীবন বাঁচানোর জন্য অতি প্রয়োজনীয় ‘রক্ত’ নিয়ে চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে চলাচলরতরা। প্রতিদিনই মহাসড়কের কুমিল্লার কোন কোন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় রক্তক্ষরণ হয়ে হাসাপাতালে ভর্তি করা হলেও ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের পাশে গুরুত্বপূর্ণ সরকারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেগুলোতে রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্র না থাকায় রক্তক্ষরন হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন শত শত যাত্রী।

শামসুল আরেফিন নামের এক বেসরকারী চাকুরীজীবী গত ৫ মে নিজ মোটরসাইকেল যোগে অফিসের কাছে চান্দিনা- রহিমানগর সড়কে দোল্লাই নবাবপুর যাচ্ছিলেন পথেমধ্যে একটি সিএনজি অটোরিক্সা তার মোটর সাইকেলকে ধাক্কা দেয়। আরেফিন সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়েন সড়কে। এসময় তার শরীল থেকে প্রচন্ড রক্তক্ষরন হয়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্বার করে চান্দিনা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দ্রæত এক ব্যাগ এবি প্রোজেটিভ রক্তের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। মুহূর্তের মধ্যে খবর পেয়ে আরেফিনের আতœীয়রা দ্রæত হসপিটালে ছুটে আসে। পরে রক্তের ব্যবস্থা না করতে পেরে তাৎক্ষনিক তারা আরেফিনকে নিয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্য রত্তনা হয়। ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কালাকচুয়া পৌছার পর প্রচুর রক্তক্ষরনের কারণে পথে মধ্যে তার মৃত্যু হয়। মাহমুদা আক্তার (১৫)। কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার বড় গোবিন্দপুর আলী মিয়া ভূঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে গত ২রা মে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে সড়ক দূর্ঘটনায় মাথায় মারাত্মক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে চান্দিনা সরকারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাত্তয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জরুরি ভিত্তিতে বি’ প্রোজেটিভ রক্তের কথা বলা হয়। মাহমুদার আতœীয় স্বজন চারোদিকে ছুটাছুটি করেও রক্তের ব্যবস্থা না করতে পেরে দ্রæত মাহমুদাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মাহমুদার ফুফাতো ভাই রাজীব বলেন, তার এখনো জ্ঞান ফিরেনি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনার পর চিকিৎসক মাহমুদাকে দুই ব্যাগ রক্ত তার শরীলে দেত্তয়া হয়। রাজীব আরো বলেন, মাহামুদা সড়ক দুর্ঘটনায় তার প্রচুর রক্তক্ষরন হয়। সে বর্তমানে শঙ্কামুক্ত নন বলে ডাক্তার জানিয়েছেন। এছাড়াও ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের দৌলতপুর নামক স্থানে মটরসাইকেল যোগে বাড়ি ফেরার পথে বেশ কয়েক বছর আগে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ রাঃ বি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মোশাররফ হোসেনকে (ক্রীড়া শিক্ষক) একটি যাত্রীবাহী বাস চাপা দিলে মারাতœকভাবে আহত হন তিনি। পড়ে স্থানীয়রা তাকে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের পাশে গৌরীপুর সরকারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। দূর্ঘটনায় মারাতœক রক্তক্ষরন হলে হসপিটালের কতর্ব্যরত ডাক্তার ওই শিক্ষককে বাঁচাতে দ্রæত রক্তের প্রয়োজনের কথা পরিবারকে জানান। পরিবারের লোকজন এদিক ওদিক ছোটাছোটি করেও রক্ত সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়া এবং ঢাকা-চট্রগ্রাম মহসড়কের পাশে জনবহুল এলাকায় অবস্থিত গৌরীপুর সরকারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্র না থাকায় রক্ষের অভাবে ওই শিক্ষকের মৃত্যু হয়। শুধু আরেফিন বা স্কুল শিক্ষক মোশাররফ হোসেনই নন, ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে চলচলরত সময়ে প্রায় সড়ক দূর্ঘটনায় স্বীকার হয়ে রক্তক্ষরনে মারা যায়। নিহত আরেফিন এর ছোট ভাই নজমুল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, রক্ত কতটা প্রয়োজন তা চাহিদার সময়ই কেবল বোঝা যায়। এক ব্যাগ রক্তের জন্য ছোটাছুটি করতে হয় রোগীর আত্মীয়স্বজনকে। ক্লান্ত হয়ে ফিরতে হয় অনেক সময়। কিন্তু রোগীর শরীর তো মানে না, তার রক্ত চাই। রক্তের অভাবে একসময় সবার মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।

তবে চিকিৎসকরা বলছেন, আমাদের দেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকেই মারা যান, বেশির ভাগই রক্তক্ষরণজনিত কারণে। রক্ত সঠিক সময়ে সংগ্রহ করে পরিসঞ্চালন করা গেলে অনেক জীবনই বাঁচানো সম্ভব। এ প্রাণগুলো অকালে ঝরে যাওয়া রোধ করতে প্রয়োজন আমাদের একটু সহানুভূতি, সচেতনতা। আমাদের এক ব্যাগ রক্তই পারে এদের জীবন বাঁচাতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের সব হাসপাতালগুলোতে ১টি করে রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্র বা বøাড ব্যাংক চালু রাখার জন্য সরকারী ভাবে বিধান থাকলেও ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের পাশে কুমিল্লার গুরুত্বপূর্ণ সরকারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্র গড়ে না ওঠায় প্রতিদিনই জেলার কোন না স্থানে রক্তের অভাবে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক মানুষ। আবার বেসরকারী ভাবে গড়ে ওঠা বøাড ব্যাংকে প্রয়োজনের সময় রোগীর আতœীয়স্বজনদের দেহের রক্তের গ্রæপ মিলিয়ে তাদের দেহ থেকে প্রয়োজনীয় রক্ত নিয়ে রোগীদের দেহে সরবরাহ করা হয়। এক্ষেত্রে রক্তের গ্রæপ নির্ণয় ছাড়া অন্য কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। বেসরকারী রক্ত গবেষনা গারে একটি বা দুটি ফ্যামাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটর, বøাড ব্যাংক ফ্রিজ, ডিফ ফ্রিজ, রক্তের নমুনা সংগ্রহের জন্য ডেমোষ্টিক ফ্রিজ, কম্পাউন মাইক্রোস্কোপ, সেল্টিফিউজ মেশিন, ওয়াটার বাথ, ইনকিউবেটর, বিউ বক্স, ডিস্টিল ওয়াটার প্লান্ট,আর্ন্তজাতিক মান সম্পন্ন প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্য ওবিং এজেন্ট থাকতে হবে। বিধিমালা ৯ (২) ঘ তে বলা হয়েছে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত চিকিৎসক ও প্রযুক্তিবিদ ও টেকনিক্যাল সুপারভাইজার, রেজিষ্টার নার্স ও ল্যাভ সহকারী থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও ইন্টারন্যাশনাল সোসাইট ফর বøাড ট্্রান্সমিশনের সংজ্ঞা এবং বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা (ডবিøউ এইচ ও) নির্দেশ মতে নিরাপদ রক্তের একজন রক্তদাতাকে কমপক্ষে পাঁচটি রক্তবাহিত ঘাতক রোগের পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়া নিতে হয়। এগুলো হচ্ছে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাটিস-সি, এইচ আইভি এইডস, ম্যালিরিয়া ও সিফিলিসের মতো কঠিন রোগ। বিশেজ্ঞরা বলেন, রক্তের জন্য আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব বা পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে বিপদের সম্মুখীন পড়তে হয়। কেননা আত্মীয় স্বজনের রক্ত ভালো মনে করে অনেকে স্কিনিং ছাড়াই তার শরীরে দিতে চায়।

ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের পাশে সরকারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেগুলোতে রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্র বা বøাড ব্যাংক না থাকার বিষয়ে দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএইচও) ডাঃ মোঃ জালাল হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল ছাড়া উপজেলা সরকারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ¯ফ্যামাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটর, বøাড ব্যাংক ফ্রিজ, রক্তের নমুনা সংগ্রহের জন্য ডেমোষ্টিক ফ্রিজ, কম্পাউন মাইক্রোস্কোপ, সেল্টিফিউজ মেশিন, ওয়াটার বাথ, ইনকিউবেটর, বিউ বক্স, ডিস্টিল ওয়াটার প্লান্ট গড়ে না ত্তঠায় রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্র স্থাপন করার কোন সুযোগ নেই। সরকারী ভাবে প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ স্থাপন করা হলে রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্র বা বøাড ব্যাংক চালু করার সম্ভব বলে তিনি জানান। তবে অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সদর হাসপাতালসহ জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিন ৪০-৫০ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে শতকরা ২৫-৩০ ভাগ পূরণ হচ্ছে পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে।

https://www.dailyinqilab.com/article/130165