৭ মে ২০১৮, সোমবার, ১০:০৬

ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে ১৩ লাখ শিশু

শিশু হলো ৩ কোটি ৯৬ লাখ ৫২ হাজার; ৫-৭ বছর বয়সী ৩৪.৪৫ লাখ শিশু কর্মরত; বাংলাদেশে ১৮টি খাতে শিশুশ্রমিক রয়েছে

শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশে এখনো সরকারি হিসাবে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। অর্থাৎ দেশে মোট শিশুর ৩২ দশমিক ২৮ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে কর্মরত। কৃষিখাতসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে অনেক বেশি শিশুশ্রমিক রয়েছে। বিশে^র অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নানা ধরনের কাজে বা শ্রমে নিয়োজিত। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কমলেও এখনো শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কমেনি। ১৮টি খাতে এখনো দেশে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার শিশু কর্মরত। যাদের মধ্যে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত আছে। এরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যা দেশের সংবিধানের মৌলিক ধারার সাথে সাংঘর্ষিক বলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা গেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের শিশুশ্রম জরিপের তথ্যানুযায়ী, দেশে পাঁচ থেকে সাত বছরের শিশুর সংখ্যা তিন কোটি ৯৬ লাখ ৫২ হাজার ৩৮৪। যার মধ্যে কর্মক্ষম শিশুর সংখ্যা হলো সাড়ে ৩৪ লাখ। যাদের বয়স পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী। এদের মধ্যে ১৭ লাখ শিশু রয়েছে, যাদের কাজ শিশুশ্রমের আওতায় পড়েছে। আর প্রায় তের লাখ ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। এসব শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকায় তাদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার সুযোগ হতে বঞ্চিত হচ্ছে, যা দেশের সংবিধানের মৌলিক ধারার সাথে সাংঘর্ষিক।
জরিপের তথ্যানুযায়ী, মোট কর্মক্ষম শিশুদের মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় ২৪ লাখ ৭০ হাজার, শহরে পাঁচ লাখ ৭০ হাজার এবং সিটি করপোরেশনে চার লাখ ৩০ হাজার জন। এদের মধ্যে ছেলে শিশু হলো ২১ লাখ এবং মেয়ে শিশুর সংখ্যা হলো সাড়ে ১৩ লাখ। এসব শিশুশ্রমিক কাজ করছে বাসাবাড়িতে, কৃষিতে, উৎপাদনমুখী শিল্পে, নির্মাণ শিল্পে, খুচরা, পাইকারি ব্যবসায় ও পরিবহনে। কৃষিতে ৩৬.৯ শতাংশ, উৎপাদনমুখী শিল্পে ২৭.৩ শতাংশ, বনবিভাগ, মৎস্য খাতে ২৭.৪৬ শতাংশ, ১৭.৩৯ শতাংশ কাজ করছে সেবা ও পণ্য বিক্রিতে। তবে বিবিএসের ২০০৩ সালের জাতীয় শিশুশ্রম সমীায় দেখা গেছে, তখন প্রায় ৭৪ লাখ কর্মরত শিশু ছিল। তাদের মধ্যে ৩১ লাখ ৭৯ হাজার শিশুর কাজ শিশুশ্রমের আওতায় ছিল। তবে এক দশকের ব্যবধানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের সংখ্যা তেমন কমেনি। কমেছে মাত্র ১১ হাজার। ২০০৩ সালে দেশে ১২ লাখ ৯১ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ছিল।

এ দিকে ১৮তম আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদদের সম্মেলন, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এই শ্রম অনুমোদনযোগ্য। আর পাঁচ থেকে ১১ বছর বয়সী কোনো শিশু যদি কোনো ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটি শিশুশ্রম হবে। তারাও কর্মরত শিশুদের মধ্যে পড়ে যায়। অন্য দিকে, পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে স্বীকৃত।
বিবিএসের জরিপের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮টি খাতে ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ জন শিশু ‘শিশুশ্রমে’ নিয়োজিত রয়েছে। তাদের মধ্যে সাত লাখ ৪৫ হাজার ৬৯০ মেয়েশিশু। শিশুশ্রম বেশি দেখা গেছে কৃষিেেত্র ও কলকারখানায়। সেখানে ১০ লাখের বেশি শিশু কাজ করে। সবচেয়ে বেশি সাড়ে পাঁচ লাখ শিশু উৎপাদন খাতে বা কলকারখানায় কাজ করে। আর কৃষি খাতে কাজ করে পাঁচ লাখ সাত হাজার শিশু। দোকানপাটে এক লাখ ৭৯ হাজার শিশু, নির্মাণশিল্পে এক লাখ ১৭ হাজার শিশু কাজ করে। শিশুশ্রমে নিয়োজিতদের ৫৭ শতাংশের কাজই অস্থায়ী। বর্তমানে শিশুশ্রমে নিয়োজিত আছে এমন ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু এক সময় স্কুলে গেলেও এখন আর যায় না। আর এক লাখ ৪২ হাজার শিশু কখনই স্কুলে যায়নি। এসব শিশুর সবাই দারিদ্র্যের কারণে পড়াশোনা বাদ দিয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।

সরকারের নেয়া নতুন কর্মসূচি হিসেবে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ হাজার শিশু, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩০ হাজার শিশু, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ হাজার শিশু এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা হবে। এ জন্য ২৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছরের জন্য একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে আগামী মঙ্গলবার। এই প্রকল্পটির কাজ দেশের ১৪টি জেলা ও সিটি করপোরেশনে বাস্তবায়ন করা হবে। আর সেগুলো হলোÑ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে দু’টি উপজেলাসহ সিটি করপোরেশন, কুমিল্লা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, বরিশাল। মোট এক লাখ শিশুকে শ্রম থেকে মুক্ত করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, বাংলাদেশ সরকার, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে এরই মধ্যে দেশের তৈরী পোশাক খাত ও চিংড়ি রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকাগুলোকে পুরোপুরিভাবে শিশুশ্রম মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তারা স্বীকার করছেন, কৃষিখাতসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোতে অনেক শিশুশ্রমিক হিসেবে এখনো নিয়োজিত রয়েছে। আর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে শিশুশ্রম কমছে, তবে তা প্রত্যাশিত নয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলেও শিশুশ্রমিকের সংখ্যা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়ে গেছে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে অল্প বয়সী এসব শিশু অমানবিক পরিশ্রম করছে। এই শ্রম বন্ধে কঠোর আইন থাকলেও তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকায় শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না। শিশুশ্রম বন্ধে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করে জোরালোভাবে তা পর্যবেণের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের সচেতন করতে মন্ত্রণালয় থেকে নোটিশ জারি করতে হবে। জাতীয় শিশুনীতিতে এটি স্বীকার করা হয় যে, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে শিশুরা নানা শ্রমে নিয়োজিত হয়। এ েেত্র গ্রামে-শহরের কোনো ভেদ নেই।

 

 

 

 

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/316265