৭ মে ২০১৮, সোমবার, ১০:০১

ভ্রাতৃঘাতী সঙ্ঘাতে অশান্ত পাহাড়

ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পাহাড়ে উপদলীয় কোন্দল চরমে। বর্তমানে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে চারটি গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পাহাড়ের বিবদমান দু’টি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল চারটি উপদলে বিভক্ত হয়ে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ায় পাহাড় আবারো অশান্ত হয়ে উঠেছে।

গত দুই দিন আগে পর পর খুন হয়েছেন রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা এবং ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ দলের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ চার পাহাড়ি ও এক বাঙালি গাড়িচালক। তারা প্রয়াত শক্তিমান চাকমার শ্মশানযাত্রী ছিলেন। খাগড়াছড়ি থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে নানিয়ারচর আসার পথে তার আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা অস্ত্রধারীরা তাদের ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। এ ঘটনার পর জনমনে ভর করেছে নানা শঙ্কা, ভয় ও আতঙ্ক।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তির পর এ দু’টি দলের প-েবিপে অস্ত্রের মহড়া, অব্যাহত বন্দুকযুদ্ধ, অপহরণ ও চাঁদাবাজির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় সময় যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিবেশ বিরাজ করে। এ ছাড়া বহিরাগত সন্ত্রাসীরাও পাহাড়ি ভূমি দখল, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ব্যবসা, অপহরণ বাণিজ্য এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে জড়িত।
সন্তু লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অস্ত্র সমপর্ণ করে। সেই সময় এর বিরোধিতা করে জন্ম নেয় পাহাড়ের আরেক আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এর নেতৃত্ব দেয় প্রসিত বিকাশ খীসা ও সঞ্জয় চাকমা।

শান্তিচুক্তির শর্তমোতাবেক পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদে চেয়ারম্যান পদে আসীন হন, যা দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এখনো বহাল রয়েছে।
সন্তু লারমার নেতৃত্বধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি শুরু থেকেই ইউপিডিএফের রাজনীতি ও মতাদর্শকে মানতে পারেনি। ফলে উভয় সংগঠনের মধ্যে প্রতিনিয়ত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত লেগেই থাকত। এতে প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির দীর্ঘসূত্রতার কারণে পাহাড়ে সংঘাত বাড়ছে। তিনি বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা এই ধরনের হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থন করি না। তিনি বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পাহাড়ের সংগঠনগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ছে। তিনি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের সুদৃষ্ট কামনা করেন এবং চুক্তি বাস্তবায়ন হলেই পাহাড়ের শান্তি ফিরে আসবে বলে মন্তব্য করেন।

বাঙালি সুশীলসমাজের প্রতিনিধি ও সাবেক ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর আলম মুন্ন বলেন, আমরা কোনোভাবেই এটা মেনে নিতে পারি না। আমরা সবাই শঙ্কিত এবং আতঙ্কিত। এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর বক্তব্য স্পষ্ট হওয়া উচিত। বাংলাদেশের এই অংশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা আমাদের সবারই দরকার। এই অংশ বিচ্ছিন্ন করার যে ষড়যন্ত্র চলছে তা বন্ধ হওয়া দরকার। সুশীলসমাজ ও দেশপ্রেমিক যারা আছে সবাইকে মুখ খুলতে হবে।

তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য আমরা প্রতিনিয়ত বলছি। সরকার এই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এখনই দরকার সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ। তিনি পার্বত্য অঞ্চলের সন্ত্রাসীদের দমনে র্যাষবের ইউনিট স্থাপনের দাবি জানান।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে চারটি। এগুলো হলো- পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), সংস্কারবাদী বলে পরিচিত জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ থেকে বেরিয়ে অধুনা আত্মপ্রকাশ করা গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ। পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনীতিতে আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারের জন্য দলগুলো এখন একের পর এক খোনাখুনির ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে রাঙ্গামাটির সুশীলসমাজের নেতৃবৃন্দ মনে করেছেন। অপর দিকে পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলোর কোন্দল এবং পাহাড়ের আধিপত্য বিস্তার অস্ত্রের মহড়া এবং চাঁদাবাজির কারণে পাহাড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন রাঙ্গামাটি বাঙালি নেতৃবৃন্দ।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতি পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বার করলে এর বিরোধিতা করে প্রসিত চাকমার নেতৃত্বাধীন একদল পাহাড়ি ছাত্র ও যুবক।
পরে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে তাদের নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এরপর দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালে বিভক্তি দেখা দেয় জনসংহতি সমিতির মধ্যে।
২০০৭ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ভেঙে রূপায়ন দেওয়ান, সুধাসিন্ধু খীসা, শক্তিমান চাকমা ও তাতিন্দ্র লাল চাকমাসহ কিছু নেতাকর্মীর নেতৃত্বে গঠিত হয় জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) দল।
সর্বশেষ ইউপিডিএফ ভেঙে আত্মপ্রকাশ করে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দল। এসব দলের নেতাকর্মীরা মরিয়া পাহাড়ে আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে। এ নিয়ে চলছে খুনের বদলা খুন। বলি হচ্ছেন অনেকে।
গত দুই দশকে প্রাণ হারিয়েছে এসব দলের ৫ শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক। দল প্রতিষ্ঠার ছয় মাসের মাথায় খুন হলেন তিন সহকর্মীসহ ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা।


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/316263