৭ মে ২০১৮, সোমবার, ১০:০০

গণিত ইংরেজি ও মানবিকের ফল প্রভাব ফেলেছে

বিশ্লেষণ

এবারের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার (২০১৮ শিক্ষাবর্ষের) ফলাফলের সব কয়টি সূচক নিম্নমুখী। একমাত্র জিপিএ ৫ ছাড়া। পাসের হার, বোর্ড ও বিষয়ভিত্তিক ফলাফল এবং গণিত, ইংরেজি এবং মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা এবার ফল খারাপ করেছে। এ ছাড়া শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠান কমেছে, শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। মেধায় ছেলেরা এগিয়ে থাকলেও গড় পাসে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে। মাদরাসাসহ সব বোর্ডে পাসের হার কমেছে। ভিন্ন ভিন্ন এসব বিষয় এবারে সার্বিক ফলাফলে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। প্রশ্ন ফাঁসের প্রভাব তো ছিলই। এসবের পরও নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়নের প্রভাব পড়েছে পাসের হারে। শিক্ষার মান মূূল্যায়নের সূচক এবার নি¤œমুখী। গতকাল প্রকাশিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রকাশিত ফল বিশ্লেষণে এসব বিষয় মোটা দাগে উঠে এসেছে।

গত ৯ বছরের মধ্যে এবারই মাধ্যমিকে পাসের হার সবচেয়ে কম (৭৭.৭৭ শতাংশ)। দেশের আটটি সাধারণ শিা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীায় এ বছর গড় পাসের হার ৭৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। গতবার এ হার ছিল ৮১ দশমিক ২১ শতাংশ। সব বোর্ডের গড় হার ৭৭.৭৭ শতাংশ। গত কয়েক বছর ধরে পাসের হার শতভাগ প্রায় ছুঁই ছুঁই করলেও এবারই পাসের হার ৭০’র ঘরে। সাধারণ আটটি বোর্ডের মধ্যে একমাত্র কুমিল্লা বোর্ডেই ফলাফল গত বছরের ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। অপর সাতটি বোর্ডসহ মাদরাসা ও কারিগরি বোর্ডেও পাসের হার গত বছরের চেয়ে কমেছে।
পরীক্ষার ফলাফলে এ নিম্নমুখী ধারার কারণ খুঁজতে গতকাল আনুষ্ঠানিক ফল প্রকাশের পর পরই বোর্ড চেয়ারম্যানদের সাথে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি সব বোর্ডকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এর কারণ অনুসন্ধানের প্রতিবেদন আন্তঃবোর্ড সমন্বয় কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বৈঠকে সব বোর্ড চেয়ারম্যানদের খারাপ করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বোর্ডে ডেকে এনে কারণ জানতে চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। মন্ত্রী সিলেট বোর্ড এবার কেন ফলাফলের তলানিতে তা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুসের কাছে ওই বৈঠকে জানতে চান। তিনি মন্ত্রীকে জানান, এবার গণিতে ফল খারাপ করার কারণে ফল তলানিতে গেছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এ বোর্ডে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কোনো গণিত শিক্ষক নেই। শিক্ষার্থীদের লন্ডন-প্রবণতা রয়েছে বলেও মন্ত্রীদের অবহিত করেন তিনি। এ ব্যাপারে পরীক্ষা উন্নয়ন কমিটি (বেদুর) সহায়তা নেয়া হবে বলেও তিনি বৈঠকে অবহিত করেন।

শিক্ষাবোর্ডগুলোতে পাসের হার নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে গণিত। এ ছাড়া ইংরেজিতেও সব বোর্ডে পাসের হার গত বছরের চেয়ে সব বোর্ডে কমেছে। পরীার ফলাফলে নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত গণিত বিষয়ে সব বোর্ডে শিার্থীরা খারাপ করেছে। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে গণিত বিষয়ে শিার্থীরা এখনো পারদর্শী হতে পারেনি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, বরিশাল, কারিগরি ও মাদরাসা বোর্ডে ১৫-২০ শতাংশ শিার্থী গণিত বিষয়ে ফেল করেছে। আর পাসের হারে শীর্ষে থাকা রাজশাহী বোর্ডে গণিতে পাসের হার ৯১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। কুমিল্লা বোর্ডে পাসের হার বাড়িয়েছে গণিতে পাসের হার বেশির কারণে। সিলেটে এ হার মাত্র ৭৬.৬১ শতাংশ। সিলেট বোর্ডের পরীা নিয়ন্ত্রক কবির আহমেদ বলেন, সাধারণ গণিত ও ইংরেজিতে ফলাফল খারাপ করার কারণে এবার পাসের হার কমেছে। শুধু গণিত বিষয়ে ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে।

একাধিক বোর্ডের চেয়ারম্যানের সাথে আলাপকালে তারা জানান, গণিত বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নে শিার্থীরা খারাপ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাদরাসার বোর্ড। এ বোর্ডে গণিতে অকৃতকার্য হয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক ছায়েফ উল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, এবার গত বছরের চেয়েও খারপ করেছে পরীক্ষার্থীরা। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এবারের গণিতের প্রশ্ন অন্যান্য বারের চেয়ে কঠিন হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশেরই অভিজ্ঞ গণিত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। মাদরাসা বোর্ডের অধীনে এ সমস্যা আরো প্রকট।

গত দুইবছর থেকে উত্তরপত্র মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এটিও এবারের ফলাফল পাসের হারে প্রভাব ফেলেছে। পরীক্ষকদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের গুণগতমান যাচাইয়ের জন্য একটি প্রশ্নমালা সব প্রধান পরীক্ষকদের সরবরাহ করা হয়েছে।
আন্তঃশিা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, বর্তমানে উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়ে শিার্থী-অভিভাবকদের আপত্তি ছিল। গবেষণায় আমরাও নম্বর প্রদানে বড় রকমের বৈষম্য পেয়েছি। দেখা গেছে, কোনো উত্তরে শিার্থী হয়তো নম্বর পাওয়ার যোগ্য নয়, কিন্তু দেয়া হয়েছে। আবার যেখানে নম্বর বেশি পাওয়ার কথা সেখানে কম দেয়া হয়েছে। এসব নিরসনের ল্েয উত্তরপত্র মূল্যায়নে এ উদ্যোগ নেয়া হয় বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে প্রত্যেক প্রধান পরীককে বাধ্যতামূলকভাবে ১২ শতাংশ খাতা নিরীা করতে হয়েছে। বোর্ড কর্তৃপকে এটা নিশ্চিত করেছে। এ পদ্ধতি সার্বিক পাসের হারে প্রভাব ফেলেছে। শিার্থীরা গণিত, ইংরেজি বিষয়ে বেশি খারাপ করেছে। এ দুই বিষয়ের খারাপ ফল পুরো বোর্ডের পাসের হারে প্রভাব ফেলেছে।

বিভাগওয়ারী ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিজ্ঞান ও ব্যবসা শিক্ষায় পাসের হার যথাক্রমে ৯৩ দশমিক ০৭ শতাংশ ও ৮০ দশমিক ৯১ শতাংশ। মানবিকে পাস করেছে মাত্র ৬৯ শতাংশ। এটি অন্যতম বড় ব্যবধান সৃষ্টি করেছে পাসের হারে। সব বোর্ডেই মানবিকের শিক্ষার্থীরা খারাপ করেছে।
শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে, কমেছে শতভাগ পাস প্রতিষ্ঠান : এবারের ফলাফলে সব বোর্ডে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠান কমেছে গত বছরের চেয়ে। গত বছর এর সংখ্যা ছিল সব বোর্ড মিলে দুই হাজার ২৬৬টি। এবার এর সংখ্যা কমে হয়েছে এক হাজার ৫৭৪টি। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ৬৯২টি।

শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত স্কুল, মাদরাসা ও করিগরি স্কুলগুলোর মধ্যে ১০৯টি প্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষার্থী এ বছর উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এসব প্রতিষ্ঠানে কতজন করে শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল তার কোনো পরিসংখ্যান দেয়নি বোর্ডগুলো। শুধু বলেছে, গত বছর এর সংখ্যা ছিল ৯৩টি। এক বছরের মধ্যে ১৬টি বাড়ল। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা প্রতি বছর বলা হলেও এ পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারি অনুদান বা শিক্ষকদের বেতনভাতা স্থগিত করা হয়েছে কি না তা বলা হয় না। প্রতি বছরই মন্ত্রী বলেন, ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে ও হবে।

মেধায় ছেলেরা এগিয়ে ,গড় পাসের হারে মেয়েরা
প্রকাশিত পরীক্ষায় সার্বিক ফলাফলে মেয়েদের তুলনায় ভালো করেছে ছেলেরা। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তির দিক থেকে এগিয়ে ছেলেরা। আর পাসের হারের দিক থেকে এগিয়ে মেয়েরা। ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছর পরীক্ষায় মোট সাত লাখ ৯২ হাজার ৯৭ জন ছেলে অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে পাস করেছে ছয় লাখ ২০ হাজার ৯৯১ জন। তাদের পাসের হার ৭৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ৫৫ হাজার ৭০১ জন। অন্যদিকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণে মেয়েদের সংখ্যা ছিল আট লাখ ৩২ হাজার ৩২৬ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ছয় লাখ ৬৮ হাজার ৮১৪জন। তাদের গড় পাসের হার ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ৫৪ হাজার ৯২৮ জন। এটি সাধারণ আট বোর্ডের পরিসংখ্যান।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/316244