৭ মে ২০১৮, সোমবার, ৯:৫৭

রাজনৈতিক দলগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী ‘ভূত’

চলতি ২০১৮ সালকে ‘নির্বাচনী বছর’ হিসেবে গণ্য করা হলেও এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উৎসাহ-উদ্দীপনার পরিবর্তে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী ‘ভূত’ যেন রাজনৈতিক দলগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কি সরকারি মহল আর কি বিরোধীরা- কেউই এই ‘ভূতগ্রস্ত’ পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারছে না। সরকারিমহল একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিতে এখনও দ্বিধাগ্রস্ত কেন সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনষ্ঠিত নির্বাচনকে সরকার কখনোই জাতির কাছে কোন গ্রহণযোগ্য বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে স্বীকৃত ব্যবস্থা হিসেবে গৃহীত হওয়ার দাবি করতে পারেনি। তারা নিজেরাই এ নির্বাচনকে নিছক সাংবিধানিক বাধ্যবধকতা হিসেবে অভিহিত করে ছিলো। অন্যদিকে বিরোধীরা একটি ‘কলঙ্কজনক’ অধ্যায় হিসেবে এই নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে আসছে। পর্যবেক্ষরা বলছেন, যেকোন প্রকারে ক্ষমতায় থাকতে হলে সেই অপকৌশলের পুনরাবৃত্তি করা ছাড়া সরকারের সামনে অন্য বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। তবে কৌশলে কিছুটা পার্থক্য আনা হতে পারে। এই কৌশলের অংশ হিসেবে প্রধান প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে ফেলার পরিকল্পনা কাজ করে চলেছে। বিরোধীজোটের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক চাপের মধ্যে রাখা হচ্ছে। শীর্ষ নেতৃত্বকে কারাবন্দী রেখে নির্বাচনী মাঠ নিজেদের আয়ত্তে রাখতে চাচ্ছে। নেতা-কর্মীদেরকেও অবিরাম থানা-হাজত-আদালত-জামিনের মধ্যে আটকে রাখা হচ্ছে। অন্যদিকে তাদেরকে রাস্তায় কোন কর্মসূচি বাস্তবায়নের সুযোগই দেয়া হচ্ছে না। এমনকি ঘরোয়া সভা-বৈঠকও বাঞ্চাল করে দেয়া হচ্ছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে। নির্বাচনের সময় যতো ঘনিয়ে আসবে ততই এই দমন-পীড়নমূলক তৎপরতা জোরদার হবে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগের সামনে দু’টো অপশন- হয় যেকোন মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখা অথবা ‘নিরাপদ প্রস্থান পথ’ নির্মাণ করা। এই দু’টি অপশন ধরেই এখনকার দৌড়াদৌড়ি চলছে বলেও রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা মনে করেন। সরকারদলীয় নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিবেশী দেশে দল ধরে যাতায়াতের কারণ সম্পর্কে ‘রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা’র কথা বলা হলেও জনমনে এনিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। এই সফরের সঙ্গে উপরের অপশন দু’টির সম্পর্ক আছে কি-না তাও জানা যাচ্ছে না। সরকারি দলের নেতৃবৃন্দ মুখে যাই বলুন বা যতই দলের বৈতরণী সহজে পার হওয়ার আশ্বাস ছাড়ু–ন না কেন, খোদ সরকারি দলের লোকেরাই তা বিশ্বাস করেন না। নিবিড় আলাপ-আলোচনায় এমনটিই মনোভাব প্রকাশ দেখা যায় দলের অনেক নেতা-কর্মীকে।

কলঙ্কজনক নির্বাচনের মডেল : বর্তমান সরকারের আমলে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের পেছনে যে সব প্রক্রিয়া-অপকৌশল ব্যবহার করা হয়ে আসছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, বিরোধীদের প্রচার-প্রচারণায় অব্যাহত বাধা প্রদান, হামলা ও গ্রেফতার আতঙ্ক বজায় রাখা, পাড়া-মহল্লায় গিয়ে বিরোধী ভোটারদের হুমকি দেয়া, আগের রাতেই দলীয় প্রতীকে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা, কেন্দ্র দখল করে প্রতিপক্ষকে ভিড়তে না দেয়া, আইনপ্রয়োগকারীদের নগ্নভাবে দলের পক্ষে ব্যবহার, নির্বাচন কমিশনকে কেবল হুকুমের দাস করে রাখা, বিরোধী নির্বাচনী এজেন্টদের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করা, সাংবাদিক-পর্যবেক্ষকদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়া, অনিয়ম-অভিযোগ আদৌ আমলে না নেয়া, নির্বাচনী কর্মকর্তা ও কর্মীদের সর্বদা ভীতি ও চাপে রাখা, ব্যালট ছিনতাই করে গণহারে সিল মারা, সাধারণ ভোটারদের ভোট প্রদানে বাধা দেয়া, ভোটের অংকে ইচ্ছেমত হেরফের ঘটানো প্রভৃতিসহ রয়েছে সবধরনের অপকৌশল। ‘নির্বাচন কমিশন’ নামক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ও জন-আস্থা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে বলেও অভিমত দিয়েছেন পর্যবেক্ষকরা। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের আমলে আয়োজিত বিভিন্ন নির্বাচনে একেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ ও ৫ এপ্রিলের তিন সিটির নির্বাচনে এসব ছিলো সাধারণ চিত্র। সেই সংসদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে শুধু মহাজোটের শরীকরা অংশ নিলেও এবং ভোট একতরফা হওয়া সত্ত্বেও ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ, সর্বনি¤œ ভোটার উপস্থিতি, জাল ভোটের মহোৎসব ও ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সেগুলো পূরণ করা, একেকজন শত শত ভোট দিয়ে উল্লাস প্রকাশ, সর্বাধিকসংখ্যক কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হওয়া, বহুসংখ্যক প্রার্থীর ভোট বয়কটের ঘোষণা দেয়া প্রভৃতি ঘটনা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে চরমভাবে কলঙ্কিত করে। অন্তত ৪১টি কেন্দ্রে আদৌ কোন ভোট পড়েনি- এমন ঘটনাও ঘটে। আবার বেলা ১টার মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট কাস্টিং হলেও বিকেল ৪টায় তা হয়ে যায় ৭০ ভাগের ওপরে। দলের একেকজন কর্মী ১শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ পর্যন্ত ভোট দেবার ‘গৌরব’ অর্জনে সক্ষম হয়। অনেক স্থানে পুরো একটি পরিবারের ভোট অন্যরা দিয়ে দেয়। বিভিন্ন কারণে সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৫শ’ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করতে হয়। তিনশ’ আসনের মধ্যে অর্ধেকেরও কম আসনে ভোট করতে গিয়েও এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এছাড়া বিভিন্ন অভিযোগ এনে ভোট গ্রহণের দিনে অন্তত ২০ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। তাঁদের মধ্যে মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টি, জাসদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ছিলেন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাণহানীর ঘটনাও একটি রেকর্ড। শুধু নির্বাচনের দিনই ২১ জনের মতো লোক নিহত হবার খবর পাওয়া যায়। বিশ্লেষকদের মতে, এ নির্বাচনকে ঘিরে যে সহিংসতা হয়েছে তা অতীতের কোনো নির্বাচনে দেখেনি দেশবাসী। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’ লোকের প্রাণহানী ঘটে। এছাড়াও সেই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দি¦তার বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি হয়। সেই সংসদ নির্বাচনকে কোন কোন ভাষ্যকার ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ তামাশা’ বলে আখ্যায়িত করেন। কোন নির্বাচন ছাড়াই ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জিতিয়ে দেয়া হয় ভাগবাটোয়ারার হিসেব অনুযায়ী। এসব আসনে কাউকে ভোট দেয়ার জন্য ভোট কেন্দ্রে যেতে হয়নি। বাকি ১৪৭ আসনে কেবল নির্বাচনের মহড়া দেয়া হয় ৫ জানুয়ারি। এগুলো শুধু পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের জোটের শরীকদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়। একজন বিশ্লেষকের মতে, একদিকে ১৫৩টি আসনের জন্য ৪ কোটি ৬৮ লক্ষ ৬৯ হাজার ভোটারকে ভোট দেয়া তো দূরের কথা, ভোট কেন্দ্রে যেতেও হয়নি। আর বাকি ১৪৩টিতে ভোটের নামে কী করা হয়েছিলো দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করেছে। কোন কোন আসনে মোট ভোটারের মাত্র ৬ শতাংশ ভোট নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড সৃষ্টি হয়। এই নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যাও ছিল ইতিহাসের সর্বনি¤œতম। অন্যদিকে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে অপব্যবহারের ক্ষেত্রে এক নয়া রেকর্ডও স্থাপিত হয়। নির্বাচন কমিশন কার্যত সরকারের আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বলা হয়ে থাকে, বিরোধী দলবিহীন এই নির্বাচনে সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়মকে নিয়ম হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। জাতীয় পার্টি সরে পড়ায় অনেক আসনে প্রার্থীসংকট দেখা দিলে কমিশনের পরামর্শে রিটার্নিং কর্মকর্তারা অনেক প্রার্থীকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে মনোনয়নপত্র শুদ্ধ করে দেন।

এছাড়া কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি ও সহিংসতা ঘটে ব্যাপক হারে। এই নির্বাচনে পর্যবেক্ষকদের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পঞ্চম পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির হার ছিলো ৫৩ শতাংশ। এ ছাড়া ৫০ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা ঘটে, ৭৬ শতাংশ ভোটারকে ভয়ভীতি দেখানো হয়, ২০ শতাংশ ভোটারকে ভোট প্রদানে বাধা দেয়া হয়, ৫৯ শতাংশ পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয় এবং ৩৮ শতাংশ পর্যবেক্ষককে গণনা পর্যবেক্ষণ করতে দেয়া হয়নি। এছাড়া কেন্দ্রে ভোট শুরুর আগেই বাক্সে সিল মারা ব্যালট পাওয়া ও ব্যালট ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে। সাধারণ ভোটাদের কেন্দ্রে প্রবেশের পর হাতে কালি লাগিয়ে দিয়ে বলা হয় তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে। ভোট না দিয়েই ওই ভোটারদের ফিরে আসতে হয়। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে, ৫ দফায় অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে তাদের টনক নড়ে। ফলে তারা পুকুর চুরির পরিবর্তে সাগর চুরির পরিকল্পনা করে। এ কথার প্রমাণ মেলে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ.টি ইমামের বক্তব্য থেকে। দুই দফা উপজেলা নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীদের লেজেগোবরে অবস্থা হওয়ার পর তিনি ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ‘যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে’ নির্বাচনে খারাপ ফল করেছে। আগামী নির্বাচনগুলোতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নেবে।’ অভিজ্ঞ মহলের মতে, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে যে ‘নির্বাচনী কারচুপি’ পদ্ধতির সূচনা করা হয় এরশাদ তার বিকাশ ঘটান। আর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সেই পদ্ধতির ষোলকলা পূর্ণ হয়।
‘ভূতগ্রস্ত’ নির্বাচনে আগ্রহ নেই : অন্যদিকে বিরোধীপক্ষও ৫ জানুয়ারি স্টাইলের সেই ‘ভূতগ্রস্ত’ নির্বাচনী ব্যবস্থায় অংশ নিতে আগ্রহী নয়। তারা ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, শীর্ষ নেতৃত্বকে নির্বাচনের বাইরে কোন ভোট দেশে হবে না। গত ৪ মে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আইনবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ এ প্রসঙ্গে বলেন, ৫ জানুয়ারির মতো দেশে আর কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। ‘আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে সরকারকে বাধ্য করি।’ সংগঠনের সভাপতি এ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, আবদুল মতিন, সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ, বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী প্রমুখ। সভায় ড. কামাল হোসেন বলেন, জনগণের ঐক্য থাকলে সব কিছু সম্ভব। এই নাগরিকদের ঐক্যের কারণে এরশাদের মতো এতো বড় স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে। দেশে আইনের শাসন নেই উল্লেখ করে প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী রায় দেয়ায় প্রধান বিচারপতিকে অন্যায়ভাবে, অসাংবিধানিকভাবে বিদায় করা হলো। আমরা এর বিচার চাই।’ আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘নির্লজ্জ ও অনৈতিক সরকারের’ উদাহরণ অভিহিত করে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘এই সরকার কতটা নীতিহীন এবং কতটা স্বৈরশাসক হতে পারে তা এই সরকারের আচরণই প্রমাণ করে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আমাকে বলেছিল আর একটি জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু এরপর ২০১৪, ১৫, ১৬, ১৭ গেল নির্লজ্জভাবে তারা এখনো দেশ চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের লজ্জা নেই, নীতি নেই। এরা আমাদের ওপর বসবে, আর আমরা মেনে নেব? আসুন সব আইনজীবী ঐক্যবদ্ধ হয়ে জেলায় জেলায় আন্দোলন ছড়িয়ে দেই। দলমত নির্বশেষে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হই। তা না হলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে।’

গত ২২ এপ্রিল রাজধানীর এক সমাবেশে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বেগম জিয়াকে আটকে রেখে সরকার মনে করছে আরেকটা ৫ জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন করবে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, ‘নির্বাচন তখনই হবে যখন দেশে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি হবে, নির্বাচন তখনই হবে যখন বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত হয়ে আসবেন এবং আমাদের নেতৃত্ব দেবেন, নির্বাচন তখনই হবে যখন দেশে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে। আমাকে আপনি কোনো কিছুই করতে দেবেন না, হাত-পা বেঁধে রাখবেন আর বলবেন সাঁতার দাও- সেটা তো হবে না। সুতরাং শুভ বুদ্ধির উদয় হোক আপনাদের। খালেদা জিয়া ছাড়া কোন নির্বাচন হবে না, জনগণ হতে দিবে না।’
একজন পুলিশ কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা : সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী দলীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীগণ ও সংসদ সদস্যদের স্ব স্ব পদে বহাল রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা পূর্ণ ক্ষমতা হাতে রেখেই ঢাল-তলোয়ারবিহীন বিরোধীদের বিরুদ্ধে নির্বাচন যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় ভোট করলে কী মাত্রায় ক্ষমতার প্রয়োগ করা যায় তার এটি নমুনা দেয়া হলো। গত ২০১৪ সালের ২৬ জুন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সদর আসনের এমপি শামীম ওসমানের ভাই নাসিম ওসমানের মৃত্যুতে এই উপনির্বাচনে প্রার্থী হন শামীম ওসমানের আরেক ভাই জাপার সেলিম ওসমান। এখানে আওয়ামী লীগেরও দু’জন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। এই উপনির্বাচনে পুলিশী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জের সহকারি পুলিশ সুপার বশির আহমদকে কী পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছিলো সেই বিবরণ তিনি দিয়েছিলেন চ্যানেল-২৪’এর কাছে। টিভির রিপোর্টার সরাসরি সম্প্রচারে (লাইভ) জানান, পাঁচ মিনিট আগে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হলেও ফুলহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের একদম সামনে বলা চলে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা মিছিল করছে। কারণ চারটার পরে বেশকিছু মানুষকে তারা ভোটকেন্দ্রে ঢোকাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যরা সেই কাজে বাধা দিয়েছেন। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোথাও কোথাও স্থানীয় সংসদ সংসদের কাছে থেকে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। টিভি রিপোর্টার এবিষয়ে সেখানে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ কর্মকর্তা বশির আহমদের কাছে সেই বাধার বিষয়ে জানতে চাইলে বশির আহমদ এর বিবরণ দেন। তিনি জানান, মদনপুর ইউনিয়ন এবং ধানকড় ইউনিয়নে পুলিশের প্রোগ্রাম অনুযায়ী সাব সেক্টর ইনচার্জ ছিলাম আমি। মদনপুর ইউনিয়নের কেউডালা কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার এবং পুলিশের স্টাইকিং ফোর্সের ইনচার্জ আমাকে জানালেন যে, মদনপুর ইউনিয়নের সালাম চেয়ারম্যান বলছেন, ‘তাকে তার মতো কাজ করতে দিতে হবে। নইলে এখান থেকে কেউ মাথা নিয়ে যেতে পারবে না। পুলিশ-আনসার-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ বেঁচে থাকবে না।’ আমি তাকে ডাকতে লোক পাঠালাম। কিন্তু তিনি না এসে অন্যের টেলিফোনে কথা বললে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি ভোট দিয়েছেন? ভোট দিয়ে থাকলে চলে যান। আজ আপনি শুধু একজন ভোটার। আপনি কাউকে ডিসটার্ব করবেন না।’ তিনি বললেন, ‘আপনি কি আমাকে থ্রেট দিচ্ছেন?’ বললাম, ‘থ্রেট তো আপনি দিচ্ছেন। বলছেন পুলিশের কেউ মাথা নিয়ে যেতে পারবে না।’ তিনি আমাকে বললেন, ‘আপনি কে? থাকেন কোথায়? আপনাকে দেখাচ্ছি।’ আমি বিষয়টি পুলিশ সুপারকে জানালে তিনি তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন। এসপি ফোর্স পাঠালে আমি র্যানব-বিজিবিকে জানালে আমার ফোর্সের সংখ্যা বাড়লো। তাকে গ্রেফতারের প্রস্তুতি নিলে শামীম ওসমান সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিয়ে বললেন, ‘আমি সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বলছি। তুমি আমার চেয়ারম্যানকে গ্রেফতারের প্রিপারেশন নিচ্ছ কেন?’ আমি বললাম, ‘আপনার চেয়ারম্যান কেন্দ্র দখল করতে আসলে আমি গ্রেফতার করব না? আর সে আপনার চেয়ারম্যান কিনা তা আমার দেখার বিষয় নয়।’ উনি আমাকে বললেন, ‘প্লিজ, আমি শামীম ওসমান বলছি। আমি কাউকে প্লিজ বলি না। তুমি কেন্দ্রটা ছেড়ে দাও। তোমার মত করে চলে যাও। গিভ হিম দা ক্লিয়ারেন্স, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ৪টার ভেতরে ৭০-৮০% ভোট কাস্ট করতে হবে। তুমি কেন্দ্র ছেড়ে দাও এবং চলে যাও।’ আমি বললাম, ‘আমি পারবো না। আমি এখন নির্বাচন কমিশনের আন্ডারে। আর নৈতিকভাবেও এটা আমি করতে পারি না, এখানে আমি প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে এসেছি।’ পরে উনি আবার আমাকে ফোন দিলেন, আরেক ফোনে প্রধানমন্ত্রীর পিএস-১ জনৈক মালেক সাহেবের সাথে কথা বললেন। বললেন, ‘মালেক, তুমি প্রধানমন্ত্রীকে বলো, আমি কি রাজনীতি করবো, কি করব না।’ এটা আমাকে ফোনে শুনাচ্ছে। আমি বল, ‘আপনি কার সাথে কথা বললেন এটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমি ছোট অফিসার আমি এখানে দায়িত্ব পালন করতে এসেছি। আমাকে দায়িত্ব পালন করতে দিন।’ তিনি আমাকে কুত্তার বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা, বাস্টার্ড বলে অকথ্য গালিগালাজ করলেন। আমি বিষয়টি ফোর্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। উনি যখন কথা বলছিলেন তখন র্যা বের মেজর সোহেল সাহেব শুনেছেন, তাকে এটা লাউড স্পিকারে শুনিয়েছি। ড্রাইভার, বডিগার্ড শুনেছে। বশির আহমদ টিভি রিপোর্টারের প্রশ্নের জবাবে জানান, ‘এ ঘটনায় আমি শঙ্কিত। আমি এটা কন্ট্রোলকে জানিয়েছি, নোট দিয়েছি।’

 

http://www.dailysangram.com/post/329437