৬ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:৪১

উচ্চ মাধ্যমিকের বাংলা-ইংরেজি বই ছাপার টেন্ডারে অংশ নেয়নি কোনো প্রতিষ্ঠান

সরকারি কাজের টেন্ডারের জন্য কাড়াকাড়ি হলেও উল্টো ঘটনা ঘটেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে। উচ্চ মাধ্যমিকের বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যবই ছাপাতে টেন্ডার আহ্বান করলেও নির্ধারিত সময়ে কোনো প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়নি। কোনো প্রতিষ্ঠানের সাড়া না পাওয়ায় নির্ধারিত সময়ে বই ছাপা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, একাদশ শ্রেণির প্রায় ৩০টি বিষয়ের মধ্যে বাংলা সাহিত্য, বাংলা সহপাঠ (উপন্যাস ও নাটক) এবং ইংরেজি প্রথমপত্র (ইংলিশ ফর টুডে)-এ তিনটি বই এনসিটিবি নিজস্ব লেখক দিয়ে প্রস্তুত করে বেসরকারি প্রকাশকদের মাধ্যমে ছাপানো হয়। এর বিনিময়ে এনসিটিবি প্রতিবছর প্রায় পাঁচ কোটি টাকা রয়্যালটি (সম্মানী) পায়। এবার প্রায় ২৪ লাখ বই ছাপার জন্য ২৪টি লটে টেন্ডার দেয়া হয়।
গত সপ্তাহ টেন্ডার ওপেন হওয়ার পর এনসিটিবির কর্মকর্তারা রীতিমত ‘থ’ হয়ে যান। একটি প্রতিষ্ঠানও এতে অংশ না নেয়ায় সমঝোতার মাধ্যমে কাজ দেয়ার চেষ্টা হলেও বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তা আটকে যায়। প্রকাশকরা বলছেন, এনসিটিবির দায়িত্বহীনতা এই সংকটের পেছনে দায়ী। তারা জানান, সারা দেশে এসব বইয়ের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজারে প্রচুর নকল বই বিক্রি হয়। এনসিটিবির ছাপানোর আগেই বাজার নকল বইয়ে সয়লাব হয়ে যায়। গত বছর প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের এক থেকে দেড় লাখ বই বিক্রি হয়নি। তা এখনো গোডাউনে পড়ে আছে। এ ছাড়াও চলতি বছর আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দাম টন প্রতি ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা বেড়েছে। কাগজ তৈরি পাল্প, কালিসহ শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। কিন্তু এনসিটিবি গত বছরের দামে এ টেন্ডার আহ্বান করেছে। প্রকাশকরা অভিযোগ করেন, প্রতিষ্ঠানটি প্রতিনিয়ত বৈষম্য তৈরি সৃষ্টি করছে। নিজেরাই ৪০ হাজার টাকা বেশি দামে কাগজ কিনছে, আর আমাদের ক্ষেত্রে আগের বছরের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে।
কোনো প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ না নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা মানবজমিনকে বলেন, দ্রুত আবার টেন্ডার আহ্বান করা হবে। যারা প্রথমবার অংশ নেয়নি তারা দ্বিতীয়বার অংশ নেবে সেই নিশ্চয়তা কী আছে, এমন প্রশ্নে চেয়ারম্যান বলেন, আমরা প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বার্তা বলার চেষ্টা করছি। আশা করি সমাধান হয়ে যাবে। আর এটার জন্য একটি কমিটি করা আছে তারা এটা নিয়ে কাজ করছে। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, আমরা কাজ করতে প্রস্তুত। কিন্তু এনসিটিবির অপরিপক্কতার কারণে বারবার এসব ঘটনা ঘটছে। তারা বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে চান না। প্রতিষ্ঠানটি নিজেরাই ৪০ হাজার টাকা বেশি দামে কাগজ কিনে কাজ দিচ্ছে, আর আমাদের বেলায় গত বছরের ৬৪ হাজার দাম ধরে টেন্ডারে অংশ নিতে বলা হচ্ছে। এসব বৈষম্য দূর না করলে শুধু একাদশ নয়, পুরো বই নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। বই নিয়ে যেকোনো ধরনের ঝামেলা হলে তার দায় এনসিটিবিকে নিতে হবে বলেও জানান তিনি। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সাবেক পরিচালক ও পুঁথিনিলয় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী শ্যামল পাল টেন্ডারের অংশ না নেয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে মানবজমিনকে বলেন, বাজারের এনসিটিবির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ বই বাজারের আসার আগেই কালো বাজারে বই পাওয়া যায়। তাদের যেহেতু এনসিটিবিকে রয়্যালটি দিতে হয় না, তাই তারা কম দামে বিক্রি করতে পারে। তাদের বইয়ের কোয়ালিটি খারাপ। এসব জানার পরও কোনো অ্যাকশন নেয়া হয় না। বর্তমানে কাগজ, কালিসহ মুদ্রণ উপকরণের দাম, শ্রমিক মজুরি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদির বিল দ্বিগুণ হয়েছে। কাজ করে প্রতিবছর তো লোকসান দিতে পারবো না। এসব বিবেচনা করে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে টেন্ডারে অংশ নেইনি।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, ২০১৩ সাল পর্যন্ত এনসিটিবি নিজেই এসব বই বাজারজাত করতো। এতে প্রতিবছর লোকসানের কারণে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে অফারিং পদ্ধতিতে ১৭ জন প্রকাশকের মাধ্যমে বাজারজাত শুরু করে। গত বছর প্রকাশকদের চাপে ১৫% দাম পর্যন্ত বাড়ায়। এবার কোনো প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ না নেয়ায় এ বইয়ে ভবিষ্যৎ কী তা এখনো অনিশ্চিত। চলতি বছর তিনটি বই ছাপার জন্য ২৪টি লটে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। প্রতিটি লটে ১ লাখের বেশি বই ছাপা হয়। প্রায় ২৪ লাখের বেশি বই ১১৫ টাকা দরে ২৭ কোটি ৬০ লাখ খরচ হবে। প্রতিলটের জন্য ১৮-২০ লাখ টাকা রয়্যালটি পায় এনসিটিবি। সে হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি এখান থেকে সাড়ে পাঁচ কোটি রয়্যালটি পাবে। এ টাকা সরকারের ফান্ডে জমা দেয়া হয় না। বিভিন্ন বোনাস, নানা খাত উপখাত দেখিয়ে এ টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=116167&cat=10/