৬ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:৪১

ধান কৃষকের বোঝা

বোরোর বাম্পার ফলনেও হতাশায় হাওরবাসী

আমাদের অবস্থা খুবই করুণ। এক মণ ধান উৎপাদন করতে খরচ হয়েছে ৭শ’ টাকার মতো। এখন সে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬শ’ টাকা মণ দরে। তাছাড়া বৃষ্টির কারণে ধান শুকানো যাচ্ছে না। এবার বাম্পার ফলনের পর ভেবেছিলাম গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে একটু সুখের মুখ দেখব। ধানের দাম না পাওয়ায় সে স্বপ্ন এখন হতাশায় রূপ নিয়েছে। হাওর অঞ্চলের কৃষকের এমন আহাজারি নিয়ে আমাদের হবিগঞ্জ সংবাদদাতা মোঃ ফজলুর রহমান, নেত্রকোনা জেলা সংবাদদাতা একে এম আব্দুল্লাহ, সুনামগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা আজিজুল ইসলাম চৌধুরী ও মোহনগঞ্জ থানা সংবাদদাতা কাজী মোফাজ্জল হোসেন সবুজের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে রিপোর্টটি তৈরি করেছেন বিশেষ সংবাদদাতা সাখাওয়াত হোসেন
বোরো ধানের বাম্পার ফলনেও হাসি নেই কৃষকের মুখে। গত কয়েকদিন ধরে দুযোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ধান কাটা, মাড়াই ও ধান শুকানো ব্যাহত হচ্ছে। ফলে ভেজা ধান কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। অন্যদিকে আকাশে মেঘ দেখলে বজ্রপাতের ভয়ে মাঠে ধান কাটতে যেতে চান না শ্রমিকরা। তাছাড়া বোরো ধান কাটতে হাওরে রয়েছে ব্যাপক শ্রমিক সংকটও। পাকা ধান কাটতে না পেরে বিপাকে অনেক কৃষক। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জসহ সিলেট অঞ্চলের সব হাওর গত বছর আগাম পানিতে ডুবে যাওয়ায় কৃষকদের অর্থনৈতিক মেরুদÐ ভেঙে যায়। এ বছর বাম্পার ফলন হলেও ন্যায্যমূল্য থেকে কৃষক বঞ্চিত হওয়ায় তাদের মুখে সুখের হাসি হারিয়ে গেছে। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার বেশ কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যেখানে একমন ধানের উৎপাদন খরচ সাড়ে ৬শ’ টাকা থেকে ৭শ’ টাকা, সেখানে একমন ধান বিক্রি করা হচ্ছে সাড়ে ৫শ’ থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকা। ধান উৎপাদনে জীবন বাজি রেখে কৃষকরা কাজ করে বিক্রির সময় বরাবরই ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। মাঠ পর্যায়ে মনিটরিং করে সরকার আগাম কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করলে কৃষক এক দিকে যেমন ন্যায্য মূল্য পাবে, অন্যদিকে আগামীতে ধান উৎপাদনে আগ্রহ বাড়বে।
হাওর অঞ্চলের কৃষকদের মতে, সারাবছর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধান উৎপাদনের পর লাভবান হন মধ্যস্বত্ত¡ভোগীরা। এছাড়া এ অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষক সরকারের নানা সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকার যখন ধান ক্রয়ের সময় নির্ধারন করেন এর আগেই কৃষক ধান বিক্রি করে দেয়। ফলে মধ্যস্বত্ত¡ভোগিরা লাভবান হয়। গত বছর আগাম বন্যায় ধান নষ্ট হওয়ার পর অনেকেই সরকারী সাহায্য পাননি। ঋণ করে বা অন্য উপায়ে টাকা সংগ্রহ করে ধান উৎপাদনের পর সঠিক দাম না পাওয়ায় অনেক কৃষকের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসন মঈনউল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ধান ক্রয় করার জন্য এখনও সরকারী বরাদ্দ আসেনি। আজ (রোববার) এ বিষয়ে মিটিং রয়েছে। ওই মিটিংয়ে সার্বিক আলোচনা করা হবে। নেত্রকোনা জেলায় অধিকাংশ কৃষক উৎপাদিত ধান এরই মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন, এ সময় ধানের দাম বাড়ানো হলে কৃষক উপকৃত হবে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি সরকারের সিদ্ধান্ত। সারাদেশকে নিয়েই সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়গুলো অবহিত করতে পারি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ থানাধীন হাটনাইয়া আলীপুর গ্রামের কৃষক মোঃ শাহিনুর মিয়া শেখ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের অবস্থা খুবই করুন। একমন ধান উৎপাদন খরচ ৭শ’টাকা। আর বিক্রি করতে হচ্ছে ৫৯০ থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকার মধ্যে। বৃষ্টির কারনে কৃষক ধান শুকাতে পারছে না। ফলে বাম্পার ফলনের পরেও ব্যাপক লোকসানের মধ্যে পড়তে হচ্ছে কৃষকদের। তিনি বলেন, সরকার ধান কাটার শুরুতেই ধান ক্রয় করলে কৃষক বাঁচবে। না হলে ধান উৎপাদনের বিকল্প চিন্তা করতে হবে আমাদের। আগামী দিনগুলো কিভাবে পরিবার নিয়ে চলবো তা চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না। এ অবস্থা এ অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষকের বলে কৃষক মোঃ শাহিনুর মিয়া শেখ মন্তব্য করেন।
খালিয়াজুরী উপজেলার বানুয়ারী গ্রামের কৃষক জুয়েল চৌধুরী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বাজারে ধানের মূল্য অনেক কম হওয়ায় লাভ তো দূরের কথা উৎপাদন খরচই উঠে আসছে না। এর ফলে বছরে একটি মাত্র ফসলের আবাদকারী হাওর এলাকার কৃষকদের দিন কাটছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়।
কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, মিটামইন ও অষ্টগ্রামের বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, পাকা ধান কাটার কাজে এখন চরম ব্যস্ত সময় পার করছেন হাওর এলাকার কৃষকরা। কিন্তু সেই ধান বিক্রির জন্য কৃষক যখন বাজারে নিয়ে আসছেন, হতাশ হয়ে পড়ছেন ধানের দাম শুনে। কারন ধানের উৎপাদন খরচই পা”্ছনে না তারা। বোরো ধান একমাত্র ফসল। এই বোরো ধান প্রাপ্ত অর্থই বেশিরভাগ কৃষকের সারা বছরের জীবিকার একমাত্র উৎস।
তাদের মতে, সার, বীজ, সেচ, শ্রমিকের মজুরি সব মিলিয়ে বোরো চাষে আমাদের যে খরচ হয়েছে আর বাজারে ধানের যে দাম- এতে করে আমাদের আর ভবিষ্যতে ধান চাষের উপায় নাই। ধান চাষ করে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।
কিশোরগঞ্জের কৃষক মতিউর রহমান ভূইয়া ওরফে শাহীন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমরা কোন দিকে যাব। বিগত দুই তিন বার আমদের ফসল পানিতে গেল। আর গত বছর তো একটি ধানও পাইনি। এখন পাকা ধান কাটতে শ্রমিক সংকট। আর যাও পাচ্ছি মজুরি অনেক বেশি চায়। ধানের দামও অনেক কম। মোঃ ফজলুর রহমান, হবিগঞ্জ থেকে জানান, হবিগঞ্জে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে শ্রমিক সংকটের কারণে কৃষকদের ধান কাটতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। বর্তমানে ধানের দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে কম হওয়ায় ফসল পেয়েও কৃষকদের মুখে হাসি ফুটছে না। বর্তমানে বাজারে বা গ্রামাঞ্চলে মোটা ধান প্রতি মন ৪৫০/- থেকে ৪৮০/- টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এর চিকন ধান বিক্রি হচ্ছে ৫৫০/- থেকে ৫৭০/- টাকা মন। কৃষকদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, গড়ে প্রতি মন মোটা ধান উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৫০০/- থেকে ৫৫০/- টাকা। যা ধানের বর্তমান বাজার দর থেকে ৭০/৮০ টাকার বেশী। উৎপাদন খরচের চেয়ে ধানের দাম কম হলেও প্রান্তিক ও বর্গা চাষীরা দেনা পরিশোধ সহ বিভিন্ন কারনে তাদের উৎপাদিত ধান কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। চলতি বোরো মৌসুমে হবিগঞ্জ জেলায় কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর ১ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হবে বলে লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করলেও অর্জিত হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৫শ হেক্টর। যা লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে ৫ হাজার ৫শ হেক্টর বেশী। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এতে চাল উৎপাদন ধরা হয়েছে ৫ লাখ মেট্রিক টন।
কাজী মোফাজ্জল হোসেন সবুজ, মোহনগঞ্জ থেকে জানান, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওরসহ ভিবিন্ন হাওরে এবার বোরোর বাম্পার ফলন হলেও এলাকায় ধান কাটার শ্রমিক স্বল্পতা ও ধানের মূল্য কম থাকাসহ নানান সমস্যায় এলাকার কৃষকরা এবার দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। গতকাল শনিবার সরেজমিনে উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওর পাড়ের জৈনপুর, শ্যামপুর, রামপাশা, সিয়াধার ও খূরশিমূল এলাকা ঘূরে কৃষকদের সাথে কথা বলে তাদের এসব সমস্যার কথা জানা গেছে। উপজেলার খুরশীমূল গ্রামের কৃষক মলয় দেব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গত বছরের প্রায় দেড় লাখ টাকা ঋন মাথায় নিয়ে এবারও আমি ডিঙ্গাপোতা হাওরে ১৩ একর জমিতে নতুন করে আরো ১লাখ ২০ হাজার টাকা ঋন করে বোরো আবাদ করেছিলাম। বৃষ্টি থাকায় হাওর থেকে যাতায়াতের রাস্তাটিও নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নাম মাত্র মূল্যেই আমাদেরকে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মফিজুল ইসলাম নাফিস বলেন, গত কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টির কারনে কৃষকেরা কিছুটা সমস্যায় পড়েছেন।
এ কে এম আব্দুল্লাহ, নেত্রকোনা থেকে জানান, হাওরাঞ্চলের কৃষকরা তাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের সোনালী ফসল ঘরে তুলতে গিয়ে শ্রমিক সংকটে পড়ে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখা দেয়ায় উদ্বিগ্ন কৃষকরা অতিরিক্ত মজুরী দিয়ে হাওরের ফসল শেষ পর্যন্ত ঘরে তুলতে সক্ষম হলেও ধানের দাম কম হওয়ায় তারা হতাশ। মোহনগঞ্জ উপজেলার তেতুলিয়া গ্রামের জামাল মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এক মন ধান উৎপাদন করতে খরচ হয় প্রায় ৭ শত টাকা, সেখানে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে সাড়ে ৫ শ থেকে ৬ শ টাকায়। গরীব কৃষকের দিকে সরকারের কোন সুদৃষ্টি নাই। কেন্দুয়া উপজেলার চিরাং ইউনিয়নের দুল্লী গ্রামের কৃষক সবুজ মিয়া বলেন, অনেক স্বপ্ন ছিল, ধান ঘরে উঠলে এবার ধুমধাম করে মেয়েকে বিয়ে দেব। ছেলে মেয়েদের ভাল জামা কাপড় কিনে দিব। কিন্তু ধানের দর কম থাকায় সেই স্বপ্ন ভেস্তে যেতে বসেছে। জেলা প্রশাসকমোঃ মঈনউল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আগামীকাল এ ব্যাপারে মিটিং আছে। মন্ত্রনালয় থেকে বরাদ্দ পেলেই দ্রæত ধান চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হবে।
সুনামগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, সুনামগঞ্জে গত কয়েকদিন থেকে দুর্যোগপুর্ণ আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতের কারনে বোর ধান কাটা, মাড়াই দেয়া ও ধান শুকানো ব্যাহত হচ্ছে। ধান বিক্রি করেও ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না তারা। গত বছর ধান পানিতে ডুবে যাওয়ায় এবার কৃষকরা ধান পেয়ে কিছুটা স্বস্থির নিশ্বাস ফেলছেন।এবার এখনও ধান বিক্রি পুরোদমে শুরু না হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ভেজা ধান ৫‘শ টাকা মন। কৃষকদের উৎপদন খরচ, ধান কাটা মাড়াই দেয়া এবং গোলায় তোলা পর্যন্ত খরচ বেশী পড়ায় ৫‘শ টাকা মন দরে ধান বিক্রি করে কৃষকরা লাভবান হতে পারছেন না, এমনটাই বলছেন বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/129808/