৬ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:৪০

পর্যাপ্ত মজুদেও দাম বাড়ানোর ফন্দি

দেশে ভোগ্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও রমজান সামনে রেখে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। রমজান শুরু হতে সপ্তাহ দুয়েক বাকি থাকলেও এরই মধ্যে বাজারে দাম বেড়েছে পেঁয়াজের। মাসখানেক আগেও প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ৩০-৩৫ টাকা ছিল। তিন দফায় তা বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা। অর্থাৎ এক মাসে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ১৫-২০ টাকা। আমদানি করা পেঁয়াজের দামও এক মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ১৫ টাকার মতো বেড়ে ৩৫-৪০ টাকায় উঠেছে। রসুন ও আদার দামও কিছুটা বেড়েছে এই সময়ের মধ্যে। বাজার বিশ্লেষক, অর্থনীতিবিদ ও অনেক ভোক্তার আশঙ্কা, রমজান শুরু হওয়ার আগেই ভোজ্য তেল, ডাল, চিনি, ছোলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়ে যেতে পারে।

বছরের বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানো হলেও রমজান মাস শুরু হওয়ার সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকে তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সরকারি হিসাবের পাশাপাশি ভোজ্য তেল, ডাল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ ও খেজুর আমদানিকারকরাও বলছে, এসব পণ্যের উৎপাদন ও আমদানি পর্যাপ্ত রয়েছে। রমজান উপলক্ষে এসব পণ্যের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তবে এরই মধ্যে কিছু পণ্যের দাম বাড়ার জন্য খুচরা ব্যবসায়ীদের দায়ী করছে পাইকারি বিক্রেতা ও বাজার বিশ্লেষকরা। আর রাষ্ট্রের স্থায়ী মূল্য কমিশন না থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা একে অন্যকে দোষারোপ করে সারা বছর ভোক্তাদের পকেট কাটে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনারও পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
বিশ্লেষকদের মতে, রমজানে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দেয়। আবার দাম বাড়ার আশঙ্কায় অনেক ভোক্তাও আগেভাগেই বেশি করে পণ্য কিনে রাখতে উঠেপড়ে লাগে। এ কারণে রমজান শুরু হওয়ার ১০-১৫ দিন আগেই বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা।
ভোগ্যপণ্যের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানায়, নির্বাচনের বছর হওয়ায় সরকার আগেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে আমদানি সমস্যার সমাধান করেছে। রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না বলে পাইকারি ব্যবসায়ীরাও কথা দিয়েছে সরকারকে। তবে খুচরা বাজারের বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছে না তারা।
রমজানের আগে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে আজ রবিবার থেকে ন্যায্য মূল্যে তেল, চিনি, ছোলা, মসুর ডাল ও খেজুর বিক্রি করবে রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বলেন, রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে সেগুলোর দাম বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই। কারণ ব্যবসায়ীদের কাছে চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণ মজুদ রয়েছে। কেউ বাজার অস্থির করে তোলার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি। কিন্তু মন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর বাজারে দাম বেড়েছে পেঁয়াজ, রসুন ও আদার।
জানা গেছে, পেঁয়াজ আমদানির প্রধান উৎস ভারতের বাজারে কোনো অস্থিরতা নেই। দেশে উৎপাদনও হয়েছে পর্যাপ্ত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২১.৫৩ লাখ টন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, এই সময়ে আমদানি হয়েছে ১২.৬৭ লাখ টন। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানির পরিমাণ ৪.৫০ লাখ টন। শুধু রমজানে ২-২.৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। আর সারা বছর এর চাহিদার পরিমাণ ২০-২২ লাখ টন।
হিলি স্থলবন্দরের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াও ২৯ এপ্রিল বুদ্ধপূর্ণিমা, ১ মে পবিত্র শবেবরাত ও মে দিবস উপলক্ষে চার দিন হিলি স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় কেজিপ্রতি এক থেকে দুই টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে রমজানের আগে আগে পেঁয়াজের দাম আবার কমবে।’
ঢাকার শ্যামবাজারের আড়তদারদের দাবি, পেঁয়াজের আমদানি কম হওয়ার কারণেই দাম বাড়ছে। মেসার্স সিকদার অ্যান্ড সন্সের ব্যবসায়ী এম এম তারুনার রশিদ বলেন, রমজান সামনে, তাই চাহিদা বেড়েছে। অন্যদিকে আমদানি কিছুটা কম। সে কারণে দাম বেড়েছে।
সয়াবিন তেলের পর্যাপ্ত মজুদ থাকার তথ্য উঠে এসেছে সম্প্রতি সরকার ও ব্যবসায়ীদের এক বৈঠকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে এনবিআরের তথ্য উল্লেখ করে জানানো হয়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি হয় ২৯.২ লাখ টন অপরিশোধিত তেল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানির পরিমাণ ছিল ১৪.৩১ লাখ টন। এর ধারাবাহিকতা পরের মাসগুলোতেও বজায় ছিল বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। ট্যারিফ কমিশনের তথ্য মতে, রমজানে ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টন। সে হিসাবে মজুদ অনেক বেশি বলে জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা।
ট্যারিফ কমিশনের তথ্য মতে, শুধু রমজান মাসে চিনির চাহিদা রয়েছে আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টন। চিনির বাজার প্রধানত আমদানিনির্ভর। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চিনি আমদানির পরিমাণ ১৭.৩৭ লাখ টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানির পরিমাণ ৩.৫৬ লাখ টন। চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আমদানি হয়েছে সাত লাখ ৭২ হাজার টন। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ পর্যন্ত ৬৮ হাজার ৫৬২ লাখ টন চিনি উৎপাদিত হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি চিনিকলগুলোর কাছে আগের কিছু চিনি মজুদ রয়েছে বলেও জানা গেছে।
চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিগত বছরে ধরপাকড়ের ভয়ে এবার চিনি নিয়ে তেমন কোনো অস্থিরতার সুযোগ নেই। শীর্ষ ব্যবসায়ীরা এবার বেশ সতর্ক হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, বছরজুড়েই চিনির বাজারে অস্থিরতা তেমন ছিল না। রমজান শুরু হওয়ার আগে ডিও ব্যবসায়ীর কারসাজিতে কিছু অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা হতে পারে।’
রমজানে ছোলার চাহিদা ৪০-৪৫ হাজার টন, মজুদ ৭০-৭৫ হাজার টন : ঢাকার রহমতগঞ্জের ছোলা আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রমজানে ৪০-৪৫ হাজার টন ছোলার চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে ব্যবসায়ীদের কাছে মজুদ আছে ৭০-৭৫ হাজার টন। আর ৩৫-৪০ হাজার টন বিভিন্ন প্রকারের ডালের চাহিদার বিপরীতে এর চেয়ে বেশি পরিমাণ মজুদ রয়েছে ব্যবসায়ীদের কাছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ডাল উৎপাদিত হয়েছে ১০ লাখ টন। এই সময়ে মসুর ও মুগডাল আমদানি হয়েছে ৭.৫৪ লাখ টন। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডাল আমদানি হয়েছে ১.৮৫ লাখ টন।
ডালের মজুদও বেশি : ব্যবসায়ীরা বলছে, রমজানের বাড়তি চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্যের মজুদ গড়ে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে তাদের দাবি, এবার কোনোভাবেই ছোলা ও ডালের দাম বাড়ার আশঙ্কা নেই। কারণ চাহিদার তুলনায় মজুদের পরিমাণ অনেক বেশি।
রহমতগঞ্জ ডালপট্টির পাইকারি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স রাজ্জাক বিতানের আব্দুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রমজান উপলক্ষেই মূলত ছোলা বিক্রি হয়। সারা বছর সামান্য পরিমাণ চলে। এবার ব্যবসায়ীদের হাতে যে পরিমাণ মজুদ আছে, বিক্রির পরও অন্তত ২৫-৩০ হাজার টন ছোলা রয়ে যাবে। সুতরাং দাম বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই। ডালের বেলায়ও একই অবস্থা। পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।’
ডাল ও ছোলার বড় আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চাহিদার অতিরিক্ত ছোলা-ডাল মজুদ থাকায় দাম বাড়ারও কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।’
ভোক্তাদের মানসিকতা পরিবর্তনের পরামর্শ : রমজানে বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে ভোক্তাদের মানসিকতা পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রমজান মাস এলে দাম কমে, আর আমাদের দেশে বাড়ে। তবে এর জন্য শুধু ব্যবসায়ীদের দায়ী করলে হবে না। আমাদের ভোক্তাদেরও মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। এক সঙ্গে ১৫ দিনের পণ্য ক্রয়ের যে মানসিকতা তাতে পরিবর্তন আনা জরুরি। কারণ প্রতিদিন পণ্য কিনলে বাজারে চাপ পড়ে না। আর একসঙ্গে কিনলে বাজারে সংশ্লিষ্ট পণ্যের সাময়িক সংকট দেখা দেয়, যা থেকে ব্যবসায়ীরা সুবিধা নিয়ে থাকে।’
স্থায়ী মূল্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করার পরামর্শ : সম্প্রতি খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে স্থায়ী মূল্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে বাজার মনিটরিং সেলগুলোকে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। আকাশ বলেন, স্থায়ী মূল্য কমিশন না থাকায় ব্যবসায়ীরা যে যেমন ইচ্ছা ইস্যু তৈরি করছে এবং সাধারণ ভোক্তার কাছ থেকে পণ্যের মূল্য নিচ্ছে। অস্থিতিশীল বাজার নিয়ন্ত্রণে মূল্য কমিশন জরুরি।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/05/06/633006