১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১০:২১

বিমান চলাচলে বিঘ্ন ঘটালে মৃত্যুদণ্ড

বেসামরিক বিমান চলাচলে যেকোনো ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টির ঘটনা প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান যুক্ত করে নতুন আইন করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ এই শাস্তির বিধানসংবলিত আইনের খসড়া আজ সোমবার আবার মন্ত্রিসভায় ওঠানোর জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে খসড়াটি গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভায় নীতিগত ও পরে চূড়ান্ত অনুমোদন হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের আইনি মত (ভেটিং) শেষে এটি জাতীয় সংসদে ওঠানোর আগ মুহূর্তে সর্বোচ্চ শাস্তির বিষয়টি নতুনভাবে সংযোজন করা হলো।
শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে আবার আইনটি মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়, গত ২৭ নভেম্বর হাঙ্গেরি যাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তুর্কমেনিস্তানে জরুরি অবতরণ করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। তখনই কঠোর শাস্তির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ওই দুর্ঘটনার পর গঠিত তিনটি তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। বিমান থেকে নয়জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত করা ছাড়াও থানায় মামলা দায়ের হয়েছে।
এই মামলার বিচার নতুন আইনে হবে কি না, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেননি বিমান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এক প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, আইনটি পাস হওয়ার সময় এর কার্যকারিতার তারিখ উল্লেখ করা হবে। তাই এটি ভূতাপেক্ষ কার্যকর না ভবিষ্যৎ থেকে কার্যকর হবে, সেটি এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন আইনে বিমান হ্যাঙ্গারে থাকা অবস্থা থেকে শুরু করে অবতরণ পর্যন্ত যেকোনো পর্যায়ে ইচ্ছাকৃত বা বেপরোয়াভাবে এমন কোনো কাজের জন্য কারও জীবন ঝুঁকির মুখে পড়লে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অনধিক পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড।
এই সাজা অন্তর্ভুক্ত করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয় কঠোর সাজার বিষয়টি প্রস্তাব করেছে। মন্ত্রিসভা আলাপ-আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
* শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে আইনের নতুন খসড়া * আজ মন্ত্রিসভায় উঠতে পারে
মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বিমান উড্ডয়নের পর দুর্ঘটনা বা অবহেলার জন্য এত দিন শাস্তির বিধান ছিল। কিন্তু বিমান চলাচলের সব প্রক্রিয়ায় শাস্তির বিধান ছিল না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও বিমান উড্ডয়নের পর দুর্ঘটনা, অবহেলা বা বেপরোয়া বিমান পরিচালনার মতো বিষয়গুলো অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।
এ প্রসঙ্গে বিমান মন্ত্রণালয়ের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিমান চলাচলের যেকোনো পর্যায়ে নাশকতা, দুর্ঘটনা বা অবহেলার জন্য এত কঠোর শাস্তির বিধান কোনো দেশে আছে বলে তাঁদের জানা নেই। তাঁরা আইনটি করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের আইনকানুন ঘেঁটে দেখেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ইমরান আসিফ প্রথম আলোকে বলেন, ভুলের সঙ্গে নাশকতা ও ইচ্ছাকৃত অপরাধের পার্থক্য থাকা দরকার। ভুল করলেই ফাঁসি—এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে বিমানে কেউ চাকরি করতে চাইবেন না। এমনিতেই সেখানে যোগ্য ও দক্ষ লোকের ঘাটতি রয়েছে। তাঁর মতে, দুর্ঘটনার কারণ যদি হিউম্যান ফ্যাক্টর হয়, তাহলে সেটা সবার আগে দূর করতে হবে। এ জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ নিশ্চিত করাটা জরুরি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানায়, প্রায় ৫৬ বছর পর বেসামরিক বিমান চলাচল আইন করতে যাচ্ছে সরকার। বিমানের বর্তমান অধ্যাদেশটিও ১৯৮৫ সালের। নতুন আইনে বিমানযাত্রীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) প্রযোজ্য নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে। ওই নীতিমালার পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে প্রস্তাবিত আইনে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আইনে বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারের বিধি প্রণয়নের ক্ষেত্র সম্প্রসারণেরও প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক এলাহী চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, যুগোপযোগী আইনের দরকার আছে, তবে এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তাঁর মতে, ইচ্ছাকৃত ভুল বা নাশকতা খুনের মতোই অপরাধ। তবে আদালতে এটা প্রমাণ করতে হবে এবং বাদীপক্ষ তথা সরকারের দায়িত্ব এটা প্রমাণ করা।
নতুন আইনে বিমান চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো ছাড়াও বিভিন্ন অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কোনো পাইলট বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বিপজ্জনকভাবে বিমান চালালে এবং তা প্রমাণিত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
বাংলাদেশের আকাশসীমায় অবৈধভাবে ঢুকে পড়লে এখন শাস্তির বিধান নেই। আইনে বলা হয়েছে, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কারণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে বিমান নিয়ে বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করলে শাস্তি সর্বোচ্চ সাত বছর ও সর্বনিম্ন তিন বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। এ ছাড়া বিমানের নেভিগেশনের সঠিক আলোক বা সংকেতের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, বিদেশিরা প্রথমেই বলেন, ‘তোমাদের আইন দুর্বল, এটা নেই, ওটা নেই। আইনটি হলে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি আর হতে হবে না।’ তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মান অর্জনে ব্রিটিশ আমলের পুরোনো আইন উন্নত করে নতুন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, ১৯৬০ সালের দ্য সিভিল এভিয়েশন অধ্যাদেশ প্রণয়নের পর বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিমান খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এবং অধ্যাদেশটি যুগোপযোগী করতে নতুন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে।
সাবেক বিমানমন্ত্রী জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। তা ছাড়া, ভুল, অবহেলা, নাশকতা ও ইচ্ছাকৃত অপরাধের বিষয়গুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে আলাদা শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। তাঁর মতে, ইচ্ছাকৃত ঘটনার শাস্তি কঠোর হতেই পারে, কারণ একটি দুর্ঘটনায় অনেক মানুষের জীবনের ঝুঁকি থাকে।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1080255/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%98%E0%A7%8D%E0%A6%A8-%E0%A6%98%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%AE%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF