৫ মে ২০১৮, শনিবার, ১০:০৩

আধিপত্যের সংঘাতে অশান্ত পাহাড়

দুই দশকের ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ী সংঘাতে অশান্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়। রাজনৈতিক আদর্শগত বিরোধের জেরে অরণ্যে লাশের রাজনীতি পেয়েছে নতুন রূপ। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মধ্য এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত ঝরে গেছে অন্তত ১০টি প্রাণ। ২৪ ঘণ্টায় খুন হয়েছেন ৬ জন। শুক্রবারের ঘটনাটি ২ দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড। সবশেষ শুক্রবার একটি আঞ্চলিক দলের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা এবং আগের দিন উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে হত্যার মধ্যদিয়ে পাহাড়ে নতু করে উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। আরও রক্তক্ষয় ঠেকাতে পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

মূলত রাজনৈতিক আদর্শগত ও আধিপত্যের বিরোধ থেকেই এ সংঘাত। সূচনা আগে থেকেই। সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের একটি সংগঠন ভেঙে এখন চারটি সংগঠন হয়েছে। প্রকৃত অর্থে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির (শান্তি চুক্তি) পর দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুধু জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে সেই সমীকরণ পাল্টে যায়। সন্তু লারমার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা ও আদর্শচ্যুতির নানা অভিযোগে বিভক্ত হয় জনসংহতি সমিতি। পাহাড়িদের কাছে দীর্ঘ লড়াই ও ঐতিহ্যের সংগঠন হিসেবে পরিচিত সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতিতে বিভক্তি আসে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এমএন লারমা) নামে নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জেএসএসের-এমএন লারমার দায়িত্ব নেন সন্তু লারমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, সাবেক গেরিলা নেতা ও প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সুধা সিন্ধু খীসা। এদিকে শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালে জেএসএস থেকে বের হয়ে প্রসীত বিকাশ খীসা, সঞ্চয় চাকমার নেতৃতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) আত্মপ্রকাশ ঘটে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ১৯ বছর পর ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টও (ইউপিডিএফ) ভেঙে যায়। ইউপিডিএফের সাবেক সামরিক শাখার প্রধান তপন চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হয়। ইপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সৃষ্টির পর থেকে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য এলাকায় একাধিক সংঘাতের ঘটনা ঘটে। শুক্রবার নিহত তপন জ্যোতি চাকমা ছিলেন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দলের প্রধান। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে নতুন এ সংগঠনটি অস্তিত্ব সংকটে পড়ল কিনা তা সময়ই বলে দেবে। এ নিয়ে গত ২ দশকের ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের ঘটনায় শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ প্রায় ছয় শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়।

এর আগে ১৫ এপ্রিল রোববার খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় জোড়া খুনে তপন চাকমা (৪০) ও বাঘাইছড়ির বিজয় চাকমা (৩২) নিহত হলেও তাদের মৃতদেহ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর রেশ না কাটতে পরদিন ১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়িতে খুন হন সূর্য বিকাশ চাকমা নামে এক সমাজকর্মী। এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানান ইউপিডিএফ (প্রসীত)। একই সপ্তাহে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে খুন হন ইউপিডিএফ সংগঠক নতুন কুমার ত্রিপুরা (৪০)। এর পর কয়েকদিন শান্তই ছিল। কিন্তু শক্তিমান চাকমা খুনের পর যখন নতুন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছিল ঠিক তখনই তপন জ্যোতি চাকমাসহ একসঙ্গে ৬ জনকে খুন করা হল ভারি অস্ত্র দিয়ে। ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে শক্তিমান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এবং একই সঙ্গে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। ভালো বক্তা হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। এদিকে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) আত্মপ্রকাশের ৬ মাসের মাথায় শুক্রবার তপন জ্যোতি চাকমা নিহত হন।

বৃহস্পতি ও শুক্রবারের হত্যাকাণ্ডের জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করা হলেও তারা তা অস্বীকার করেছে। ইউপিডিএফের (প্রসীত) প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান নিরণ চাকমা এসব হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। এর সঙ্গে ইউপিডিএফের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’ তবে নির্বাচনসহ বিভিন্ন সময়ে ইউপিডিএফের সঙ্গে জেএসএস-এমএন লারমার কৌশলগত ঐক্য ছিল। বিশেষ করে নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি, মহালছড়ি ও দীঘিনালায় সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে এ ঐক্য দৃশ্যমান ছিল। তবে জেএসএস-এমএন লারমার সাংগঠনিক শক্তি ও আধিপত্য বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে ইউপিডিএফের সঙ্গে দূরত্বও বাড়ছিল।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/45214