৫ মে ২০১৮, শনিবার, ১০:০২

আইনশৃঙ্খলার অবনতি

জনপ্রতিনিধিও খুন থেকে রেহাই পাচ্ছেন না

হঠাৎ করেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে এক দিনে দুই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে হত্যার ঘটনা এবং গতকাল পার্বত্য অঞ্চলে দুর্বৃত্তদের ব্রাশফায়ারে পাঁচজন নিহতের ঘটনায় সাধারণ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এর বাইরেও প্রতিদিনই ঘটছে খুনের ঘটনা। গড়ে প্রতিদিন ১২ জনের বেশি খুন হচ্ছেন বলে বেসরকারি কয়েকটি সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে পার্বত্য অঞ্চলে। খুন, জখম, অপহরণসহ নানা অপরাধে বেসামাল হয়ে পড়েছে পার্বত্য জেলাগুলো। সেখানে মানুষের দিন কাটছে চরম আতঙ্কে। চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ পুরো পার্বত্য অঞ্চল অস্থির করে তুলেছে। তাদের খুনোখুনিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, এসব গ্রুপকে চাঁদা না দিয়ে একটি মুরগির ডিমও কেউ বিক্রি করতে পারেন না ওই এলাকায়। ৪ মে রাঙ্গামাটির নানিয়ার চরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন সেখানকার উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তি চাকমা। তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান পালন শেষে বাড়ি ফেরার সময় ব্রাশফায়ারে নিহত হন ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক জ্যোতি চাকমাসহ পাঁচজন।
গত ৪ মে বেলা ১১টায় নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের সামনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন জেএসএসের (এমএন লারমা) সহসভাপতি ও নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা। প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। দুর্বৃত্তদের গুলিতে মোটরসাইকেল চালক সংগঠনের নানিয়ারচর উপজেলার সাংগঠনিক সম্পাদক রূপম চাকমাও গুরুতর আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগে থেকেই সেখানে ওঁৎ পেতে ছিল তিন যুবক। ওই যুবকেরা খুব কাছ থেকে শক্তিমান চাকমার ওপর গুলি চালায়। এ ঘটনার পরই পুরো পার্বত্য অঞ্চলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে।

এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মাথায় গতকাল শুক্রবার গুলিতে পাঁচজন নিহত ও ৯ জন আহত হয়েছেন। শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে খাগড়াছড়ির বেতছড়ি এলাকায় গাড়িবহরে দুর্বৃত্তরা হামলায় চালায়। বেলা সাড়ে ১১টায় এ ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে তপন জ্যোতি চাকমা ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক। গত নভেম্বরে ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। নিহত অন্য চারজন হলেনÑ সুজন চাকমা, প্রণব চাকমা, সেতু চাকমা ও তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসের চালক মো: সজীব। চালক ছাড়া অন্য চারজনই ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের সদস্য।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পার্বত্য অঞ্চলে চারটি সশস্ত্র গ্রুপ রয়েছে। এগুলো হলোÑ জনসংহতি সমিতি জেএসএস, জেএএস সংস্কার (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ এবং ইউপিডিএফ সংস্কার (গণতান্ত্রিক)। এই চার গ্রুপের বাইরেও বেশ কিছু সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। ওই চারটি গ্রুপ আঞ্চলিক রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। এদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রায়ই খুনের ঘটনা ঘটছে। তাদের কারণে পুরো পার্বত্য এলাকা এখন অশান্ত। পরপর দু’টি ঘটনা ঘিরে পাহাড়ে আরো বড় ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, এসব সন্ত্রাসীর কাছে অনেক এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও অসহায়। অনেক স্থানে থানা পুলিশকে সন্ত্রাসীদের সাথে ম্যানেজ করে থাকতে হচ্ছে বলেও স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
এ দিকে, নানিয়ারচরে যেদিন উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তি চাকমা নিহত হন সেদিনই নরসিংদীর রায়পুরার বাঁশগাড়ীতে প্রকাশ্যে ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল হককে (৭৫) কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। ৪ মে বেলা ২টায় উপজেলার আলীনগর আড়াকান্দায় এই হত্যার ঘটনা ঘটে। সিরাজুল হক বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও টানা সাতবার ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন।
একই দিনে দুই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হত্যা এবং এর রেশ না কাটতেই ব্রাশফায়ারে পাহাড়ে পাঁচজনকে হত্যার ঘটনায় সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকেই বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির লক্ষণ এটি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিদিনই খুনসহ আইনশৃঙ্খলাজনিত নানা ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন মারাত্মকরূপ ধারণ করেছে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৪ মাসে ৭৭ নারী এবং ১৭৩ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ব্যাপকভাবে বেড়েছে শিশু ধর্ষণের ঘটনা। গণপরিবহনের ভেতরেও নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
এ দিকে, পুলিশের শীর্ষ সারির কর্মকর্তারা বলেছেন, নানিয়ারচর ও নরসিংদীতে জনপ্রতিনিধি হত্যার সাথে জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, এসব খুনের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। এসব খুনের ঘটনা সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চিত্র বহন করে না বলে ওই কর্মকর্তারা উল্লেখ করেন।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/315669