২৭ এপ্রিল ২০১৮, শুক্রবার, ৭:৪৯

ঝুঁকি বাড়াচ্ছে অর্থনীতিতে

বিআইবিএমের গবেষণা প্রতিবেদন

অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ। মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে এ ঋণ বেড়েছে ১৮৮ শতাংশ। ২০১৩ সালে যেখানে এ ঋণ ছিল ৪০০ কোটি ডলার। ২০১৭ সাল শেষে তা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১১ শ’ কোটি ডলার। বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ সৃষ্টিসহ ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে দেশের অর্থনীতিকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএম অডিটোরিয়ামে ‘প্রাইভেট কমার্শিয়াল বোরোয়িং ফ্রম ফরেন সোর্সেস ইন বাংলাদেশ : অ্যান অ্যানাটমি’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উপস্থাপন করা হয়। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এবং বিআইবিএম নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মোহা: রাজী হাসান। বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিআইবিএমের মুজাফফর আহমেদ চেয়ার প্রফেসর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বরকত-এ-খোদা, সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিআইবিএমের সাবেক চেয়ার প্রফেসর এস এ চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং বিডার নির্বাহী কমিটির সদস্য নাভাস চন্দ্র মন্ডল, পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমদ চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলি, ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব -উল-আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের পরিচালক (গবেষণা উন্নয়ন ও পরামর্শ) ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জী। গবেষণাদলে আরো ছিলেন বিআইবিএমের অধ্যাপক নেহাল আহমেদ, বিআইবিএমের সহকারী অধ্যাপক রুহুল আমীন, বিআইবিএমের সহকারী অধ্যাপক অন্তরা জেরিন, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) উপসচিব মো: আরিফুল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্টের যুগ্ম পরিচালক প্রদীপ পাল।
বেসরকারি খাতে ব্যাপক ভিত্তিতে ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ১১ ধরনের ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে এ গবেষণা প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে- ফরেন কারেন্সি রিস্ক, মোরাল হ্যাজার্ড, কস্ট অব বোরোয়িং, ফরেন কারেন্সি বোরোয়িং লোকাল বিজনেস অর্গানাইজেশন, লোন ইউটিলাইজেশন, পলিসি আনসার্টিইনিটি, পলিসি সাপোর্ট, ভেরিফিকেশন অব অ্যাপ্লিকেশন, বোরোয়িং ফ্রম অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট এবং ঋণ অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা। এতে আরো বলা হয়েছে, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রায় ২৪ শতাংশ বিদেশী ঋণ পোশাক খাতে। এরপর বিদ্যুতে ২১%, সুয়েটারে ১৬%, ডায়িং ও নিট গার্মেন্টসে ১২%, টেক্সটাইলে ১১%, প্ল্যাস্টিকসে ৫%, সেবায় ৩% এবং ওষুধে ২%।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এবং বিআইবিএম নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মোহা: রাজী হাসান বলেন, ব্যবসায়ী বিশেষ করে রফতানিকারকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশী ঋণ নেয়ার অনুমোদন দেয়া হয়। তবে প্রথম দিকে এ ঋণের কিছু অপব্যবহার হয়েছিল। এখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে না। পুরো বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোরভাবে নজরদারি করছে। তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশ বেসরকারি খাতে বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলেও বিষয়টি সতর্কতার সাথে দেখতে হবে।

বিআইবিএমের মুজাফফর আহমেদ চেয়ার প্রফেসর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বরকত-এ-খোদা বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণের প্রয়োজন রয়েছে। তবে বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণ যেন ভিন্ন খাতে ব্যবহার না হয় সে দিকে বিশেষ নজরদারি করতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, বন্ড মার্কেট ডেভেলপ করলে তারল্য সঙ্কট থাকবে না। তবে এ জন্য সরকারি বন্ড মার্কেট ডেভেলপ করা জরুরি। পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নিলে ব্যাংকিং খাতে কোনো তারল্য সঙ্কট থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং বিডার নির্বাহী কমিটির সদস্য নাভাস চন্দ্র মন্ডল বলেন, ২০০৯ সালের দিকে উচ্চসুদের কারণে ব্যাংকে একটি সঙ্কট সৃষ্টি হয়। ব্যাংকঋণ নিয়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে অনেক বেশি খরচ পড়ে যাচ্ছে। আরো কয়েকটি কারণে সরকার বিদেশী ঋণের অনুমোদন দেয়। কিন্তু ঋণগ্রহীতাদের ঋণের অর্থ সঠিক বিনিয়োগ করতে হবে।
সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিআইবিএমের সাবেক চেয়ার প্রফেসর এস এ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে কোনো সংস্থার এক টাকাও খেলাপি না। অথচ ব্যাংকিং খাতে বড় অঙ্কের অর্থ ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এটা মানা যায় না। ব্যাংকে ক্যাশ রিকভারি অনেক কমে গেছে। এটি ভাবনার বিষয়। কেন এটা হচ্ছে তা খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে অর্থনীতিতে তার বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।

পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমদ চৌধুরী বলেন, বিদেশী ঋণ নিয়ে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের একটি অংশ তাদের স্থানীয় ঋণও পরিশোধ করতে দেখা গেছে। এমন ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে সে দিকে নজর রাখতে হবে।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব-উল-আলম বলেন, বিদেশী ঋণের ব্যবহার বিষয়ে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সব পক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে। বিদেশী ঋণে অনেক ধরনের ঝুঁকি রয়েছে- এ কারণে ব্যাংকারদের পাশাপাশি গ্রাহকদেরও ভালো ধারণা থাকতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদেশী ঋণ অর্থনীতির জন্য চাপ সৃষ্টি না করে সে দিকে সরকারের দৃষ্টি রাখতে হবে। রেমিট্যান্স, রফতানি এবং উৎপাদনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিদেশী ঋণ নেয়ার অনুমোদন দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলি বলেন, বিদেশী ঋণের কোনো অপব্যবহার না হয় সে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে নজরদারি করতে হবে। এটি না করতে পারলে ঝুঁকির মুখে পড়বে অর্থনীতি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/313688