২৬ এপ্রিল ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৩০

মুক্ত জীবন-রুদ্ধ প্রাণ

কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষা

তারুণ্য যে অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী, তারুণ্য যে প্রতিবাদে সাহসী হয়ে উঠতে পারে- কোটা সংস্কারের আন্দোলন তারই প্রমাণ। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এই আন্দোলন আলোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে আছে। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনাই হচ্ছে। কিন্তু যখন দেখি যারা নিজের জীবনে এমন আন্দোলনের সঙ্গে কখনও জড়িত ছিলেন না, তারা তরুণদের দীক্ষা দিচ্ছেন আন্দোলন কেমনভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত ছিল- তখন অবাক লাগে বৈকি!

আন্দোলনকারীদের উচিত ছিল আরও পরিপক্বভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করা- এমন বক্তব্য দিতে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককেও। আন্দোলনের চেহারা কিন্তু শান্তই ছিল। তবে ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় পুলিশের অভিযানের পর আন্দোলনের চেহারা বদলে যায়। কিন্তু কেউ বলছেন না, পুলিশ কেন মারমুখী হয়ে উঠল? এই আন্দোলন কী কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল?
তারুণ্যের শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘাবড়ে দিয়েছিল ক্ষমতাসীনদের। তারা ভয় পেয়েছিলেন এই ভেবে যে, এই বুঝি আন্দোলন পরিণত হবে গণআন্দোলনে এবং গণঅভ্যুত্থানে। ২০০৭ সালেও তরুণরাই কিন্তু সেনা শাসনের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও শামিল হয়েছিলেন এবং মানুষ এই আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। আজকের আন্দোলনে অতীতের সেই একতা আর নেই। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। মারামারি করার জন্য দায়ী করেছেন ছাত্রদের, কিন্তু নিজেরা যে গত কয়েক মাস ধরে নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছেন- সে কথা ভুলে গেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতরা এসে শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করছে- এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি শুধু অগণতান্ত্রিকই নয়, একদলীয় মনোভাবেরও বহিঃপ্রকাশ। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের টাকায় চলে। সেখানে প্রত্যেকের প্রবেশাধিকার আছে। শুধু একটি প্রশ্ন করতে চাই- সিনেট নির্বাচনের দিন যেভাবে বাইরের মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে এবং কখনও কখনও শক্তির মহড়া প্রদর্শন করে, তাতে কি এই শিক্ষকদের গায়ে ময়লা লাগে না? আসলে সমস্যা অন্যত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র সংগঠনের যে আধিপত্য রয়েছে, তাতে এই কর্তৃপক্ষ নিরাপদ বোধ করে। কিন্তু আন্দোলনের একপর্যায়ে এই নিরাপত্তা বোধ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলেই ছাত্রলীগের এক সদস্যার দলীয় পদ ও ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো তদন্তের ভিত্তিতে এই ছাত্রীকে বহিষ্কার করেছিলেন কিনা তা বলেননি। ভয় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই তারা এ কাজটি করেছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে যে ভয়ের সংস্কৃতি চালু আছে, নিরীহ ছাত্রছাত্রীরা যেভাবে ক্ষমতার দম্ভে বলীয়ান ছাত্র সংগঠনের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন, সে কথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানে না। জানলেও বলা হয়, এমন অভিযোগ পাইনি। পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে ইত্যাদি।

দলীয় আনুগত্যের শক্তিতেই রাতের অন্ধকারে ছাত্রীদের বের করে দিয়েও সুফিয়া কামাল হলের প্রভোস্ট এখনও ক্ষমতাসীন। যে কাজটি প্রক্টরের করার কথা, সে কাজটি তিনি আগ বাড়িয়ে করে তার সন্তানসম কন্যাদের বের করে দিলেন অন্ধকারে। শুধু কী তাই, তাদের মোবাইল ফোন পর্যন্ত কেড়ে নিলেন। এজন্যই একজন আইনজীবী দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন, ‘মেয়েদের ছাত্রত্ব বাতিল করার হুমকি, গোয়েন্দা নজরদারি এবং মামলার ভয় দেখানো- এসব কাজের প্রতিটি সুনির্দিষ্ট ফৌজদারি অপরাধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী আইন পরিপন্থী কাজ করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব প্রক্টরের। হলের প্রভোস্ট কিন্তু আইনের ঊর্ধ্বে নন। কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন চেক করা অন্যায়। হলের প্রভোস্ট কী করতে পারেন আর কী করতে পারেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে তার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। আইনের প্রয়োগ তো শুধু ক্ষমতাসীনদের জন্য। এ কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ঘটনা প্রকাশ্যে এলেও তা পরিণতির মুখ দেখে না। হোক সেটা শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ।

ছাত্রছাত্রীরা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে দীর্ঘদিন থেকে। অথচ কেউ এ বিষয়ে নজর দেয়নি, বোঝার চেষ্টাও করেনি কেন এই আন্দোলন। বাংলাদেশের লেখাপড়া শেখা তরুণদের সামনে কোনো আশার আলো নেই। বেকারত্বের আশঙ্কা তাদের গ্রাস করেছে। আবার তারা এটাও জেনেছে, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সদস্য না হলে চাকরি পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা এবং একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বক্তৃতা বিবৃতিতে স্পষ্ট হয়ে গেছে, ছাত্রলীগ না করলে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। এমতাবস্থায় তরুণদের মনে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক।
বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার জন্য ক্ষমতাসীনরা বলছেন, আন্দোলনটি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে। এই স্পর্শকাতর বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা সহজ। তাহলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে পদোন্নতি বাগিয়ে সরকারি চাকরির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছা যাবে, মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা পদক থেকে সোনা চুরি করা যাবে এবং কখনই দণ্ড ভোগ করতে হবে না।

কোটার পরিণতি কী হবে- কেউ জানেন না, অন্তত এখন পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রী ১১ এপ্রিল সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে দিলেন। অনেকেই বলেন, অভিমানে প্রধানমন্ত্রী এই ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, এই বক্তব্যের মধ্যে উষ্মা ছিল, কারণ মেয়েরাও এই কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পথে নেমেছে। আবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, ২২ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় জনপ্রশাসন সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল না করে তা সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছে। এই স্থায়ী কমিটির যারা সদস্য, তাদের প্রত্যেকেই ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের উচ্চপদে আসীন, এমনকি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীও এই কমিটির সদস্য। কমিটির সভাপতি, সাবেক মন্ত্রী ও পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য এবং সম্ভবত আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের কথা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু আমাদের কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। পিছিয়ে পড়া নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিও আমাদের দায় আছে। সংবিধানে ক্ষমতার কথা বলা আছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছে। এসব বিবেচনা করে আমরা কোটা পদ্ধতি সহজীকরণের কথা বলেছি। যুক্তিযুক্ত সংস্কারের কথা বলেছি। পাশাপাশি কোটা নিয়ে যেন কোনো ষড়যন্ত্র ও দুরভিসন্ধি না হয়, সেটাও দেখতে বলেছি।’ সংসদীয় কমিটির বৈঠকের এই আলোচনার পর সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে- কমিটি কি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে, না প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ীই কমিটি এমনভাবে চিন্তা-ভাবনা করছে?

কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মুখে কাপড় বেঁধে আন্দোলনকারী কয়েকজনকে জেরা করার নামে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে ঘৃণ্য হামলা চালানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এটা দক্ষ কারবারিদের কাজ। সম্ভবত এ কারণেই এখনও তাদের কাউকে আটক করা হয়নি। অথচ রাজনৈতিক মামলার মতো এখানেও অজ্ঞাত অনেক মানুষকে আসামি করা হয়েছে। ভবিষ্যতে ছাত্ররা আন্দোলনে নামলে এই অস্ত্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের কথিত অপরাধের জন্য যারা তার পিতাকে ধরে এনে নির্যাতন করতে পারে, তারা সবকিছুই করতে পারে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যে মাসে প্রণীত হয়েছিল, সে মাসে এমন একটি আন্দোলন থেকে আমরা কী শিক্ষা পেতে পারি? যারা আন্দোলন পরিচালনার ব্যাপারে প্রেসক্রিপশন দেন, তাদের বলতে চাই- একটু অতীতের দিকে ফিরে তাকান। পাকিস্তানিরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল বর্তমানের মতো বিভিন্ন কথা বলে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন যে মূল্যবান শিক্ষা দিয়েছে, তা হচ্ছে- তারুণ্যের দৃপ্ত পদচারণা ক্ষমতাসীনদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে পারে এবং আর একটু অগ্রসর হলে পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এ কারণেই উদ্বেগের শেষ ছিল না। তরুণদের কাছে দামি হয়ে উঠেছিল এক সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন, যেখানে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করবে না, গণতন্ত্রের বুলির আড়ালে পুলিশ দিয়ে এবং ঘৃণ্য কৌশলে আন্দোলন দমন করবে না। এই সঙ্গে এটাও বলতে চাই, হয়তো উপাচার্যের বাড়িতে হামলার কোনো কূলকিনারা হবে না।
মাহফুজ উল্লাহ : শিক্ষক ও সাংবাদিক

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/42302