২৫ এপ্রিল ২০১৮, বুধবার, ৯:২২

বিআইবিএমের গবেষণা প্রতিবেদন

চার কৌশলে অর্থ পাচার

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারের সঙ্গে বাড়ছে অর্থ পাচার। আর পাচারের ৮০ শতাংশই হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। আমদানি-রফতানিতে পণ্য ও সেবায় ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং, বহুমাত্রিক ইনভয়েসিং, মিথ্যা বর্ণনাকে কৌশল হিসেবে বেছে নেয়া হচ্ছে পাচারে। পণ্য শিপমেন্টেও ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। বিআইবিএমের গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বুধবার রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) অডিটোরিয়ামে ট্রেড সার্ভিস অপারেশনস অব ব্যাংকস শীর্ষক কর্মশালায় গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব পণ্য আমদানিতে কম শুল্ক দিতে হয়, বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রাংশ, শিল্পের কাঁচামাল এবং খুচরা যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচার করা হচ্ছে। আবার সরকারি প্রণোদনা পেতে রফতানি পণ্যে বেশি মূল্য দেখানো হচ্ছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের পাওনা পরিশোধে অসামঞ্জস্যতার প্রমাণ মিলেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং শুল্ক বিভাগের যৌথ উদ্যোগে অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম অর্থ পাচার প্রতিরোধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে কর্মশালায় অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বিআইবিএমের চেয়ার প্রফেসর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বরকত-এ-খোদা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস ভ্যালুয়েশন অ্যান্ড ইন্টারনাল অডিট কমিশনারেটের কমিশনার ড. মঈনুল খান, বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক ইয়াছিন আলি এবং গ্লোবাল ট্রেড অ্যান্ড রিসিভ্যাবলস ফিন্যান্স ও দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন লিমিটেডের (এইচএসবিসি) হেড অব কান্ট্রি মুহাম্মদ শহিদুজ্জামান।

কর্মশালার উদ্বোধন করে ডেপুটি গভর্নর বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ট্রেড সার্ভিসের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেকটি দেশে ট্রেড সার্ভিসের ক্ষেত্রে আলাদা রেগুলেশন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরাও নতুন গাইডলাইন করতে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যবসাভিত্তিক অর্থ পাচার বাড়ছে। তবে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাজ করছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। গত বছর থেকে ব্যাংকের সব কর্মকর্তাকে মানি লন্ডারিং বিষয়ে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। এলসি (ঋণপত্র) খোলার সময় আমদানিকারকদের সবকিছু যাচাই-বাছাই করতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

এনবিআরের কাস্টমস কমিশনার ড. মঈনুল খান বলেন, অর্থ পাচারের ৮০ শতাংশই হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে। এটা প্রতিরোধ জরুরি হয়ে পড়েছে। বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচার বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, এলসি খোলার সময় ব্যাংকগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। অনেক সময় অর্থ পাচারে ব্যাংক কর্মকর্তারাও জড়িয়ে পড়েন। তবে ব্যাংকগুলোকে অর্থ পাচারের কৌশল তদারকি করতে হবে। কাস্টমসের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর সমন্বয় দরকার। ৬৩৪টি পণ্যের দাম ঠিক করে দিয়েছে কাস্টমস। ব্যাংকগুলো এটি সংগ্রহ করতে পারে। তাহলে এলসি করার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।

বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলি বলেন, ৮০ শতাংশ অর্থ পাচারই ব্যাংকের মাধ্যমে হয়- এটি খুবই আশঙ্কার বিষয়। তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকে এ প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তিনি বলেন, ঋণের সুদহার কমানোর কথা বলা হচ্ছে। ১০ শতাংশ খেলাপি ঋণ রেখে ঋণের সুদহার কমবে না। এ ছাড়া ঋণের সুদহার কমানোর কথা বললেই আমানতের সুদহার কমানো হয়। তবে আমানতের সুদহার কখনও ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির নিচে নামানো যাবে না। সম্প্রতি ব্যাংক মালিকদের নানা দাবি-দাওয়া আদায়ের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ব্যাংক মালিকরা নানা ইস্যু নিয়ে সরকারের কাছে যায়। কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যাপারে তাদের উদ্যোগ কী? খেলাপি ঋণ আদায়ে এবং মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তারা কি সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছেন? কতজন শীর্ষ খেলাপিকে জেলে পাঠাতে চেয়েছেন? সে ক্ষেত্রে তাদের নীরবতা কেন? নাকি সে চাওয়া আত্মঘাতী?
এইচএসবিসি ব্যাংকের হেড অব কান্ট্রি মুহাম্মদ শহিদুজ্জামান বলেন, অর্থ পাচার রোধে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংককেই ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যাংক তার দায়িত্ব পালন করলেই অর্থ পাচার কমে আসবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসের নির্বাহী পরিচালক মো. হুমায়ূন কবির বলেন, বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যেমন বেড়েছে, একে ঘিরে জটিলতা এবং আর্থিক অপরাধও বাড়ছে। যা এখন ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যাংক কর্মীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।

বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, এলসি গ্যারান্টি ও ফি কমানোর জন্য বাংলাদেশকে ভিয়েনা কনভেনশনের সদস্য হওয়া উচিত। কেননা, আমাদের বেশিরভাগ রফতানি হয় ইউরোপ ও আমেরিকায়। ভিয়েনা কনভেনশনের সদস্য হলে এসব ফি কমবে এবং এলসির গ্যারান্টি নিশ্চিত হবে। কারণ, বিশ্বের ৮৯টি দেশ ভিয়েনা কনভেনশনের সদস্য।
বিআইবিএমের চেয়ার প্রফেসর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বরকত-এ-খোদা বলেন, অর্থ পাচার বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেও এটি ঠেকানো যাচ্ছে না। অর্থ পাচার কমিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, টাকা পাচার ঠেকাতে আইনকানুন এবং বিধি-নিষেধের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু অভাব শুধুই সততা এবং নৈতিকতার।

কর্মশালায় গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের অধ্যাপক এবং পরিচালক (ট্রেনিং) ড. শাহ মো. আহসান হাবীবের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের প্রতিনিধি দল। বিআইবিএমের কর্মশালাটি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিস থেকে অংশ নেন নির্বাহী পরিচালক মো. হুমায়ূন কবিরসহ অন্যারা।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/41942