২৫ এপ্রিল ২০১৮, বুধবার, ৯:২০

ঋণের সুদহার কমাতে বিফল উদ্যোগ

সরকারের নির্বাচনী বছরে ও ব্যবসায়ীদের চাপে ঋণের সুদহার কমাতে বহুমুখী উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এসব উদ্যোগ নিষ্ফল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তারা বলেছেন, গত কয়েক বছরে ব্যাপক লুটপাটের পর ব্যাংকিং খাতে তীব্র নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ সঙ্কট মোকাবেলায় আমানত বাড়াতে হবে। আর এ জন্য চড়া সুদেই তাদেরকে আমানত সংগ্রহ করতে হবে। চড়া সুদে আমানত সংগ্রহ করে কম সুদে ঋণ বিতরণ করা মোটেও সম্ভব হবে না। ফলে সিআরআর হার কমানোই হোক, আর ব্যাংক রেট কমানো হোক কোনো উদ্যোগই কাজে আসবে না। এতে কেবল ব্যাংকগুলোর কিছুটা তহবিল বাড়বে, তহবিল ব্যয় কমবে না।

ব্যবসায়ী ব্যাংক পরিচালকদের চাপে গত ১ এপ্রিল থেকে আমানতকারীদের সুরক্ষায় বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমানো হয়। সিআরআর হার কমানোর সময় বলা হয়েছিল ঋণের সুদহার এক অঙ্কের ঘরে অর্থাৎ ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরকে নজিরবিহীনভাবে একটি হোটেলে ডেকে সিআরআর হার কমানোর ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একই দিনে ব্যাংকগুলো স্বল্প সুদে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নিতে রেপোর সুদহারও কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক পৃথক দুটি সার্কুলারের মাধ্যমে সিআরআর হার ১ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশে এবং রেপোর হার পৌনে সাত শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনে। শুধু সিআরআর হার কমানোর ফলে গত ১৫ এপ্রিলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বাজারে ছাড়ে। কিন্তু এতেও ঋণের সুদহার কমছে না বরং বেড়ে যাচ্ছে। গত এক মাসে প্রতিটি ব্যাংকই ঋণের সুদহার ক্ষেত্রবিশেষ দুই থেকে তিন শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে।

সিআআর হার কমিয়েও ঋণের সুদহার না কমায় এখন ব্যাংক রেট কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এসব কোনো উদ্যোগই সুদহার কমানোর ক্ষেত্রে কাজে আসবে না। কেননা, গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে নানা উপায়ে টাকা বের করে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যেটুকু জানা গেছে তা হলো সোনালী ব্যাংকের হলমার্কের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা, বিসমিল্লাহ গ্রুপের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের এনন টেক্স নামক একটি কোম্পানির মাধ্যমে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট লেদার নামক আরেকটি কোম্পানির মাধ্যমে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়েছে। এ সময়ে ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটেছে। এর বাইরে আরো বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে, যা রাজনৈতিক প্রভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক হয় তদন্ত করে উদঘাটন করেনি, অথবা তদন্ত প্রতিবেদনে মূল ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে যে ব্যাপক লূটপাট হয়েছে তার ফলে ব্যাংকিং খাতে তীব্র তারল্য সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। আরো কয়েকটি ব্যাংকের তীব্র তারল্য সঙ্কট চলছে। এ পরিস্থিতিতে তারল্য সঙ্কট কাটাতে ব্যাংকগুলোকে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করতে হবে। আর উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা মোটেও সম্ভব নয় বলে তারা মনে করছেন।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মো: মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীদের চাপে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তা অনেকটাই নিষ্ফল হয়ে যাচ্ছে। কেননা, সিআরআর হার কমিয়ে কিছু তহবিল বাড়ানো যায়। আর বাংলাদেশ ব্যাংক রেট কমিয়ে শুধু দুই-একটি খাতে এক শতাংশ সুদহার কমানো যায়, সামগ্রিক তহবিল ব্যয় কমানো যায় না। এতে ঋণের সুদহার কমবে না, বরং আমানত সঙ্কটের কারণে ঋণের সুদহার বেড়ে যাবে।

সিআরআর হার ও ব্যাংক রেট কমিয়ে ঋণের সুদহার কমানো যায় না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক অনিয়মের কারণে ও ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু ওই টাকা আর ফেরত না আসায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে গেছে। এ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের আয় কমে গেছে। আর এ কারণে ঋণের সুদহার কমছে না। দ্বিতীয়ত. ঋণ আমানতের সুদহারের ব্যবধান ৩ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু এ হার কোনো কোনো ব্যাংকের ৮ শতাংশের ওপরে রয়েছে। ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের কম মুনাফা দিয়ে বেশি মুনাফায় ঋণ বিতরণ করার ফলে যে বিপুল অঙ্কের মুনাফা হচ্ছে তার ভাগিদার না হচ্ছেন আমানতকারী, না হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহক। বিপুল অঙ্কের মুনাফা করে ব্যাংকের পরিচালকরা ডিভিডেন্ডের নামে ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। এর কিছু অংশ সিএসআর-এর নামে লুটপাট হচ্ছে। সাবেক এ গভর্নরের মতে, খেলাপি ঋণের হার কমানো হলে ও ঋণ আমানতের সুদের ব্যবধান অর্থাৎ স্প্রেড কমালে ঋণের সুদহার এমনিতেই কমে যাবে।

উল্লেখ্য, ১৪ বছর পর ব্যাংক রেট ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৪ শতাংশ করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনের বছরে সুদহার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় ব্যাংক রেট কমানো হচ্ছে। ২০০৩ সালের ৮ নভেম্বর থেকে ব্যাংক রেট ৫ শতাংশে অপরিবর্তিত রয়েছে। এ সময়ে ব্যাংকের সুদহারে ব্যাপক ওঠানামা হলেও ব্যাংক রেটে হাত দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১৫ বছর পর ব্যাংক রেট কমানোর সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক রেটে বিভিন্ন ব্যাংককে দীর্ঘমেয়াদে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেশ কয়েকটি কর্মসূচির আওতায় ব্যাংকগুলো এ তহবিল পায়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৫ শতাংশ সুদে তহবিল নিয়ে ব্যাংকগুলো সাধারণত ১০ শতাংশ সুদে গ্রাহকদের ঋণ দেয়। ব্যাংক রেট কমালে ব্যাংকগুলো আরো কম সুদে গ্রাহককে ঋণ দিতে পারবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত প্রায় ৫ হাজার কর্মী গৃহনির্মাণ, গাড়ি ক্রয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাংক রেটে ঋণ পান। এ বিষয়ে শিগগিরই সার্কুলার জারি করে বিষয়টি ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেয়া হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/313150