২৪ এপ্রিল ২০১৮, মঙ্গলবার, ৭:০৯

আলোকিত সমাজের আপ্তবাক্য আউড়ে কী লাভ!

ড. মাহবুব উল্লাহ্

বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হিসেবে আমরা যাদের চিনি এবং যাদের কথাবার্তা হরহামেশাই শুনতে হয়, রেডিও-টেলিভিশনে ও সংবাদপত্রের পাতায় যাদের সরব উপস্থিতি তাদের প্রায়ই নসিহত করতে শুনি- আলোকিত সমাজ চাই, আলোকিত মানুষ চাই। কিন্তু কার্যত তারা নিজেরা কতটা আলোকিত সে প্রশ্ন উত্থাপন করা খুব অসঙ্গত হবে না।

আলোকায়ন বলতে কী বোঝায় সেই প্রশ্ন শুরুতে করা যায়। ১৭৮৪ সালে দার্শনিক ইমান্যুয়েল কান্ট্ তার একটি রচনায় বলেছিলেন, ‘আলোকায়ন হলো মানবজাতি কর্তৃক স্ব-আরোপিত অপরিপক্বতা থেকে বেরিয়ে আসা’। ধর্মীয় অথবা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের গোঁড়ামিপূর্ণ বক্তব্য ও সূত্রের প্রতি আলস্যপূর্ণ ও ভীরু আত্মসমর্পণ না করা।
আলোকায়নের প্রতিজ্ঞা হল বুঝতে সাহস করা। এর জন্য ভিত্তি তৈরি করে চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতা। একটি আলোকিত সমাজে পূর্ব-প্রজন্ম উত্তর-প্রজন্মের সঙ্গে এমন কোনো চুক্তিতে উপনীত হয় না, যেখানে পরবর্তী প্রজন্ম তাদের অন্তরদৃষ্টির প্রসারণ, জ্ঞানের বিকাশ এবং পূর্বপুরুষদের ভুল এড়িয়ে চলতে বারিত হয় না।

তাই যদি হতো, তাহলে তা হতো মানবস্বভাবের বিরুদ্ধে একটি অপরাধ। কারণ মানবস্বভাবই নির্ধারণ করে তার যথাযথ নিয়তি লুকিয়ে আছে প্রগতিতে। আলোকিত সমাজে যুক্তির প্রাধান্য সর্বাগ্রে। যুক্তির প্রশ্নে কোনো আপস হতে পারে না। মানবস্বভাবের সর্বজনীন রূপের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মানবিকতায়।
যুক্তি ও আলোকায়নের যুগে চিন্তাবিদরা নৈতিকতার ইহজাগতিক ভিত নির্মাণ করতে চেয়েছেন। কারণ তারা, বিশেষ করে ইউরোপীয় সমাজ শতাব্দীর পর শতাব্দী চলতে থাকা ধর্মীয় নিপীড়নের ভয়াবহ ঐতিহাসিক স্মৃতি, ক্রুসেড, ইনকুইজেশন, ডাইনি খুঁজে বেড়ানো (Witch hunt) এবং ইউরোপের ধর্মযুদ্ধ ইত্যাদির দ্বারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল।
এ সবকে অতিক্রম করার জন্যই প্রয়োজন ছিল মানবিকতার। পুরুষ, নারী ও শিশুদের কল্যাণ গোত্র-বর্ণ-জাতি অথবা ধর্মের তুলনায় প্রাধিকার অর্জন করেছিল। গোষ্ঠী নয়, ব্যক্তিই হল প্রাধান্যের বিষয়- এই মূলমন্ত্রটি সমাজের কেন্দ্রীয় মূল্যবোধে পরিণত হয়েছিল।

কারণ ব্যক্তিই অনুভব করে আনন্দের সুখ কী এবং বেদনার কষ্ট কী, আত্মতৃপ্তি ও ক্ষোভের মধ্যে পার্থক্য কী? এ ভাবনাগুলোর অর্থ দাঁড়িয়েছিল সমাজের বৃহত্তম সংখ্যক মানুষের জন্য বৃহত্তম সুখ নিশ্চিত করা। অথবা মানুষকে উপায় হিসেবে না দেখে লক্ষ্য হিসেবে দেখা।
মানুষের মধ্যেই বিরাজ করে অপর মানুষের প্রতি সহানুভূতি। মানুষ যদি সহানুভূতিশীল হয়, তাহলে সহানুভূতির সেই বৃত্ত পরিবার ও গোত্রকে ছাড়িয়ে পুরো মানবজাতিকে আলিঙ্গন করে। বিশেষ করে যুক্তি মানুষকে এ উপলব্ধির দিকে তাড়িত করে।
যুক্তিই আমাদের বলে দেয় আমরা নিজের জন্য যা ভালো মনে করব, অন্যের জন্যও সে রকমই মনে করব। এ কল্যাণ কামনা পরিবার, গোত্র কিংবা গাত্রবর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না।
বাংলাদেশের সমাজে আমরা কি যুক্তিবাদের প্রাধান্য দেখি? চারদিকে যা ঘটছে, তা দেখে মনে হয় আমরা যুক্তিবাদিতাকে প্রাধান্য না দিয়ে সংকীর্ণ স্বার্থবাদকে প্রাধান্য দিয়ে চলেছি। আমার এক শিক্ষক অধ্যাপক রেহমান সোবহান একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বাংলাদেশে আফ্রিকার মতো ঐতিহ্যগত গোত্রবাদ না থাকলেও এখানে এক অদ্ভুত ধরনের গোত্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে। এ গোত্রের একটি হল আওয়ামী লীগ এবং অন্যটি হল বিএনপি।

অবশ্য এ দুটি প্রধান গোত্রের বাইরেও আরও ছোটখাটো কিছু গোত্র আছে। আওয়ামী লীগ গোত্র নিজের জন্য যা কাম্য মনে করে, সেটি বিএনপির জন্য করে না; অপরদিকে বিএনপি গোত্র নিজের জন্য যা কাক্সিক্ষত মনে করে তা আওয়ামী লীগ গোত্রের জন্য মনে করে না।
এ নতুন ধরনের গোত্রবাদ এত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যে, জাতির মর্মমূলে আঘাত করার জন্য তা যথেষ্ট। এ দেশের কল্যাণবোধ খুবই সীমিত পরিসরে আবদ্ধ। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, শুধু রাজনৈতিক সভাতেই নয়, দেশের সংসদেও উচ্চারিত হয় এক ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা- হয় আমরা থাকব, না হয় ওরা থাকবে।
এই সংকীর্ণতা ও ভেদবুদ্ধি আমাদের সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছিয়ে দিতে পারে এমন উপলব্ধিরও নিদারুণ অভাব।

জ্ঞান-বিজ্ঞান, যুক্তি ও বৃহত্তর কল্যাণবোধ না থাকলে সমাজ কতটা নরকতুল্য হয়ে উঠতে পারে তা ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি। সেই সময় শিক্ষিত ইংরেজরা বিশ্বাস করত, ডাইনিরা সমুদ্রে ঝড় সৃষ্টি করতে পারে এবং জাহাজগুলোকে ডুবিয়ে দিতে পারে।
তারা বিশ্বাস করত এমন এক নেকড়ে বাঘের অস্তিত্বে, যে নেকড়ে কখনও মানুষের রূপ ধারণ করে, আবার কখনও নেকড়ে বাঘে পরিণত হয়। তারা বিশ্বাস করত ইংল্যান্ডে এ রকম প্রাণী না থাকলেও বেলজিয়ামে এদের অস্তিত্ব আছে। তারা বিশ্বাস করত ঈওজঈঊ (জাদুর দেবী) অবশ্যই অডিসিউসের নাবিকদের শূকরে পরিণত করেছিল। তারা বিশ্বাস করত খড়ের গাদায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইঁদুরের জন্ম হয়। তারা সমসাময়িক জাদুকরদেরও বিশ্বাস করত। আধুনিক ইউরোপীয় সমাজে এমন কু-সংস্কারের কথা ভাবা যায় না।

বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রসারের ফলে এসব কুসংস্কার ইউরোপীয় সমাজ থেকে দূর হয়ে গেছে। অবশ্য অধুনা ইউরোপেও এক ধরনের তমসাবাদের উত্থান লক্ষ করছি। এ তমসাবাদ বর্ণবাদকে উসকে দিচ্ছে, অভিবাসীদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করছে, এমনকি ধর্মীয় বিদ্বেষও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতির পরিভাষায় এ তমসাবাদের একটি ভালো নাম হয়েছে। নামটি হল ‘লোকরঞ্জনবাদ’। লোকরঞ্জনবাদের ভয়াবহ এ উত্থান মানব সমাজকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবে তা এখনও বলা অনিশ্চিত।

অতিসম্প্রতি সাধারণ ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলের নানা ঘটনা পরম্পরায় দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোকিত এ প্রতিষ্ঠানটিতেও যুক্তিবিবর্জিত নানা আচরণ পরিলক্ষিত হয়েছে। যে রাতে আন্দোলন তুঙ্গে পৌঁছেছিল, সে রাতেই এ হলের সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের এক নেত্রীকে হল ও দল থেকে বহিষ্কার করা হল।
তারপর এ সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে পুনর্বাসিত করা হল। তার বিরুদ্ধে এই হলের ছাত্রীদের অভিযোগ ছিল উৎপীড়ন ও নিপীড়নের। অভিযুক্ত নেত্রীর পুনর্বাসনের পর খড়্গ নেমে এলো তার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ তুলেছে তাদের বিরুদ্ধে। এবার এদের মধ্যে তিনজনকে মধ্যরাতে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে হল থেকে বের করে দেয়া হল। আবার প্রতিবাদের ঝড়ের লক্ষণ দেখে এই তিনজনকে হলে ফিরিয়ে আনা হল।

এ যেন এক তুঘলকি কাণ্ড! প্রশ্ন উঠেছে, একের পর এক যখন শাস্তি দেয়া হচ্ছে এবং শাস্তি রহিত করা হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের পন্থা অনুসরণ করা হয়েছিল কিনা। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করেনি। অথচ একটি আলোকিত সমাজে এমনভাবে বিচার চলতে পারে না।
পরিস্থিতির অত্যাবশ্যকতার কারণে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন হলেও ন্যূনতম ব্যাকরণ মেনে এসব পদক্ষেপ নেয়া যুক্তিসঙ্গত ছিল। যেমন অনুসন্ধান, কারণ দর্শানোর সুযোগ ইত্যাদি। সময়ের অভাব থাকলেও এগুলো একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া সঠিক হয়নি। তাই যদি হতো তাহলে সিদ্ধান্ত বারবার পরিবর্তন করতে হতো না।
যুক্তি ও স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের ঘাটতি ছিল বলেই এমনটি হয়েছে বলে মনে হয়। তবে এ কথাও সত্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষক ন্যায়-নীতিবোধের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। তাদের অভিনন্দন জানাই।

২০১৮ সালের এ ঘটনা আমাকে পাকিস্তান আমলের একটি বহুল আলোচিত ঘটনাকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশন আন্দোলনের বিষয়টি অনেকেরই মনে থাকার কথা। সে সময় সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো, বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথভাবে প্রাদেশিক গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের পৌরহিত্যে কনভোকেশন অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করেছিল।
কারণ মোনায়েম খানকে সরকারবিরোধী ছাত্ররা সেই সময়কার স্বৈরতান্ত্রিক আইয়ুব সরকারের সহযোগী হিসেবেই দেখেছিল। একটি দৈনিকের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘লণ্ডভণ্ড পণ্ড মণ্ডপে কনভোকেশন অনুষ্ঠিত’। ঘটনার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কয়েকদিনের মধ্যে ৪৩ ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করে।
এদের মধ্যে দু’জনের ডিগ্রিও বাতিল করা হয়। বহিষ্কৃত ছাত্রদের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টে রিট আবেদন পেশ করেন অন্যতম বহিষ্কৃত ছাত্রনেতা জাকির আহমদ। তিনি বাংলাদেশ আমলে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে নিয়োজিত হয়েছিলেন। এ রিট আবেদনের পক্ষে ওকালতি করেছিলেন অ্যাডভোকেট এসআর পাল।

রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট ছাত্রদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ বাতিল করে দেয় এবং আইনগতভাবে তা ভিত্তিহীন বলে ঘোষণা করে। বহিষ্কৃত ছাত্রদের পক্ষে অ্যাডভোকেট পালের যুক্তি ছিল, ছাত্রদের স্বাভাবিক ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
কারণ তাদেরকে তাদের আচরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেনি। হাইকোর্টের এ আদেশ পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টও বহাল রেখেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি একটি খুবই উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ সম্পর্কে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও জানা থাকার কথা।
কাউকে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। এটাই আধুনিক আইনের কথা। এটাই একটি আলোকিত সমাজের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু যখন তমসাবাদের অন্ধকার নেমে আসে, তখন এসব ন্যায়-নীতির আদর্শ পরিত্যক্ত হয়। বাংলাদেশে আলোকায়নের পক্ষে যেসব বুদ্ধিজীবী অহরহ কথা বলেন, তারা যেন সমাজে ন্যায়বিচার ও যুক্তিবাদিতার প্রশ্নগুলো ক্ষুদ্র গোত্র বা গোষ্ঠীস্বার্থে এড়িয়ে না যান এমনটাই কামনা করব। তবে সেসব মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবীকে অভিনন্দন জানাই যারা ন্যায়ানুগতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/41596