২৪ এপ্রিল ২০১৮, মঙ্গলবার, ৭:০৭

দেশ কোন পথে ধাবিত হচ্ছে?

হারুন-আর-রশিদ
সম্প্রতি দু’টি জরিপ বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ। একটিতে বলা হয়েছেÑ সুখী মানুষের র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে। আরেকটি জরিপে উল্লেখ করেছেÑ বিশ্বের যেসব দেশের রাজধানীতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, ঢাকা তার অন্যতম। এর অর্থ দাঁড়ায়, এক বছর আগে ঢাকায় বসবাসরত নাগরিকদের যে অর্থ ব্যয় করতে হতো, এখন তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। ‘সময় মাত্র এক বছর’। এই এক বছরে সরকারি বা বেসরকারি কর্মচারীদের কারো বেতন বাড়েনি। নতুন কোনো পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়নি। পণ্যমূল্য তাহলে বেড়ে গেল কেন? এ সময় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগও হয়নি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বজায় ছিল। একবাক্যে রাজনীতির মাঠ এখন ফাঁকা, খালি মাঠে গোল দিচ্ছে শুধু সরকারি দল। মাঠ এখন পুরোপুরি তাদের দখলে। তা হলে পণ্যমূল্য বেড়ে চলার হেতু কী।

১৬ মার্চ ’১৮ শুক্রবার বেসরকারি একটি চ্যানেলে মহাখালীর কাঁচাবাজারের একটি দৃশ্য দেখানো হলো। ভোক্তা ও বিক্রেতাদের মুখোমুখি হয়ে মিডিয়া প্রতিবেদক প্রশ্ন করলেন কয়েকজন ভোক্তাকে। বাজারদর কেমন মনে হচ্ছে? সবারই এক জবাবÑ সব দোকানে একই দাম। কাঁচাবাজার, মাছের বাজার এবং মুদির দোকান কোথাও দামের হেরফের দেখছি না। কেন? উত্তরে বলল, বাজার তো বিক্রেতারা নিয়ন্ত্রণ করে না, ওরা চাঁদা দেয় তাদের যাদের নির্দেশে দাম বাড়ানো হয়। সংক্ষেপে এসব বাজার নিয়ন্ত্রণকারীকে বলা হয় ‘সিন্ডিকেট অব বিজনেস’। বাংলার যার অর্থ বাণিজ্যিক সমিতি। পুঁজিবাজারও এদের দখলে। সব ধরনের বাজারই এরা নিয়ন্ত্রণ করে। ৪৬ বছর ধরে দেখছি, যখন যে দল ক্ষমতায় যায়, তারাই বাজারকে ঊর্ধ্বমুখী করে কোটি কোটি টাকা বাজার থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে। কাওরান বাজারে কর্মরত দারোগাকে জিজ্ঞাসা করলাম রাস্তার চল্লিশ ফিট জায়গাজুড়ে মুখোশধারী শিক্ষিত মানুষের দামি পাজেরো এবং দোকানপাট সড়কপথে রেখে বেচা-কেনা কোনো দেশের রাজধানী শহরে হয় না। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম কেন? দারোগা আমাকে বললেন- আপনার কথার সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করছি না। কিন্তু সত্য কথা বলা যাবে না। আপনিও জানেন আমিও জানি। এসব অনিয়মের হোতা দলীয় চক্র। এখান থেকে প্রতি মাসে দেড় কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করে নিচ্ছে সিটি করপোরেশনের যোগসাজশে সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠনগুলো। এর সাথে জড়িত আছে দলের আপার লেভেলের মানুষ। আমাদের পুলিশের কিছু অসৎ চরিত্রের লোকও এর সাথে জড়িত। তিনি বললেন, কিতাবি আইন কিতাবেই ঘুমিয়ে আছে। এ আইন তার নিজস্ব ধারায় পরিচালিত হলে দেশে দুই নম্বরী কোনো কাজই হতো না। সমস্যাটা এখানেই বন্দী হয়ে আছেÑ সমাধান কিভাবে হবে বলুন।

উল্লিখিত জরিপ দুটোর সারমর্ম এ দেশের মানুষও জানে। কথায় বলে এসব এখন ‘অচল পয়সা’। ধরুন ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট-প্রজা কষ্ট পায়’, ‘নদীর জল ঘোলা ভালো জাতের মেয়ে কালো ভালো’। রাজা, প্রজা, জাত-পাত এসব এখন উঠে গেছেÑ শব্দের চাষ হচ্ছে ডিজিটাল নিয়মে-সেই ডিজিটালটা হলো অর্থ উপার্জনের দরকার এ জন্য যা করা দরকার-সেটা অবৈধ হোক বা বৈধ হোক-তাই করবÑ এরই নাম চলমান ডিজিটাল। গতিময় হয় যদি গতিহীনÑ তাহলে সাত কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে তিন ঘণ্টা লাগবে। গাড়িতে বসে ফেসবুকে চ্যাটিং করে বা গান শুনে সময় কাটানÑ এ ছাড়া চলমান ডিজিটাল থেকে বাঁচার বিকল্প পথ খোলা নেই।
বুদ্ধিশুদ্ধি আছে এমন সব মানুষ কথা বলতে চায় না ক্রসফায়ার বা গুম হওয়ার ভয়ে। সাদা পোশাকধারী যে আপনার সামনেই দণ্ডায়মান বোঝারও কায়দা নেই। তাই বোবার শত্রু নেইÑ এমন নীতি নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়া উত্তম আদর্শ। অক্সফোর্ডের ডিকশনারিতে যা লেখা আছে তাও বর্তমান প্রেক্ষাপটে অচল। চোখ কান খোলা রাখুন, দেখবেন কিভাবে ডিজিটাল কায়দায় লুটপাট হচ্ছে। পত্রিকার হেডলাইন, বছরে একটি রাস্তা কয়বার খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়Ñ উত্তর পেয়ে যাবেন আপনার পাশে দণ্ডায়মান কোনো ব্যক্তির বাক্য থেকে, বলবেÑ স্যার আপনি কি বাংলাদেশে থাকেন, নাকি বিদেশে। এ প্রশ্ন কেন? এই যে আপনি বলছেনÑ রাস্তা কয়বার খোঁড়াখুঁড়ি হয় এক বছরে। এটাতো খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তার জন্য নয়, পেটের জন্য। অধিক চাষ যেমন প্রয়োজন মানুষকে বাঁচাতে হলে, ঠিক তেমনি কয়েকটি গাড়িবাড়ির মালিক হতে হলে বছরে কয়েকবার রাস্তাকে জবাই করতে হবে। এতে জনদুর্ভোগ বাড়ছে, সরকারি কোষাগার খালি হচ্ছে, যে কোষাগার মানুষের ঘর্মাক্ত ট্যাক্সের টাকায় ভরা হয়। আপনি কি এখনো শিশু, দেখতে তো মনে হয় ৫০ ঊধ্ব বয়সী মানুষ। তাহলে বাংলাদেশী বাঙালির কায়দায় কথা বলতে শিখুন। যেমন ধরুন, ’৭১ সালটা কি দেশের জন্য করেছি, না কোনো বিশেষ বিশেষ দল বা ব্যক্তির জন্য করেছি। পাটিগণিতের অঙ্ক দিয়ে তা মিলানো যাবে না। অনিয়মের অঙ্ক দিয়ে চলমান ডিজিটাল কায়দায় তা মিলালে উত্তর পেয়ে যাবেন। এখন সেটা সর্বক্ষেত্রে চলছে। চুরি বিদ্যা মহাপাপÑ এটা বইপুস্তকে এখনো আছে, কিছু দিন পর হয়তো থাকবে না। কারণ অনৈতিক লোকদের নৈতিক কাজে নিয়োগ দিলে সে ক্ষেত্রে সেবার নামে অর্থ লুণ্ঠন হবেই। ব্যাংকে টাকা নেই, ক্যাপিটাল মার্কেটেও টাকা নেইÑ তাহলে উন্নয়নশীল পথে ধাবিত বাংলাদেশের এত টাকা গেল কোথায়।

রাষ্ট্র পরিচালনায় আবেগ নয়, বেগ দরকার। জনগণের পালস দেখে ডাক্তার চিকিৎসা শুরু করেন। ঠিক তেমনি সরকারের উচিত জনগণ কী চায়Ñ সেটা অনুধাবন করে রাষ্ট্রের চিকিৎসা করাÑ তাহলে বিপদের আশঙ্কা কম। ভিজুয়ালাইজেশন না থাকলে শক্তির জোরে দেশ পরিচালনা করলে বিদায় নিতে হয় খুব মর্মান্তিক পদ্ধতিতে, যা নিজেদেরই সৃষ্টি। ’৭০-এর নির্বাচনের আগে আইয়ুব-ইয়াহিয়া ভাবতে পারেননি যে পূর্বাঞ্চলের মানুষ কী চায়। সেটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি টুকরো হয়ে গেল। মানুষের চাওয়া পাওয়া পূরণ করতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্র যেমন টেকে নাÑ সরকারও টেকে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন এ ধরনের একটি মেসেজ দিয়েছিলেন। ইউরোপ ও আমেরিকায় যেভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেÑ তা জনগণের মর্জিমাফিক হয়ে থাকে বলে সেসব দেশে রক্তের বন্যা প্রবাহিত হয় না। বিপদমুক্তভাবে সরকার বিদায় নেয়, নতুন সরকার নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় আসেÑ ফলে সেসব দেশের মানুষের ভোগান্তি বাড়ে না। হরতাল অবরোধ এসব হয় না। এশিয়ার কিছু মুসলিম রাষ্ট্রে এসব কেন ঘটছেÑ তা উপলব্ধি করা দরকার। বিদেশী হস্তক্ষেপ রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্বুদ্দিতার কারণে হয়ে থাকেÑ যেটা লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও সুদানে হয়েছে। জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিলে এ ধরনের ঘটনা ঘটবেই, রাজনীতি বিজ্ঞানও একই কথা বলছে। শেষে বলব, আমাদের দেশে অর্থের অভাব কার, যার যত বেশি আছে তার। এ জন্য ক্যাপিটাল মার্কেটে ধস নেমেছে, ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। গরিব মানুষ এসব করছে নাÑ করছে দেশের বিত্তশালী ব্যক্তিরা। বিল গেটস এবং অ্যামাজনের আয় করা অর্থের তিন ভাগের ২ ভাগই দুস্থ মানুষের সেবায় ব্যয় করে বলেই এসব ধনী ব্যক্তি ভালো আছেন। কিন্তু আমাদের দেশের ধনী ব্যক্তিরা সরকার পরিবর্তন হলেই বিদেশে পাড়ি জমায়। নৈতিকভাবে যারা দুর্বল তারাই এ পথে ধাবিত হয়।
লেখক : গ্রন্থকার
e-mail : harunrashidor@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/312789