২৩ এপ্রিল ২০১৮, সোমবার, ৯:৪৩

ঝুঁকির শঙ্কায় জনগণের ৭১৫ কোটি টাকা

অর্থ জোগানের প্রস্তাব অনুমোদন

দুর্নীতিগ্রস্ত ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচাতে সরকার যে বিনিয়োগ করছে- তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, এখন পর্যন্ত ব্যাংকটির বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আদায় এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো এটিকে বাঁচিয়ে রাখতে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ৭১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে।
এ অর্থের পুরোটাই জনগণের। দুর্নীতিগ্রস্ত এমন একটি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির মূল উৎপাটন না করে মোটা অঙ্কের অর্থ জোগান দেয়া মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ লুটপাটের আশঙ্কা থাকছেই।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ফারমার্স ব্যাংককে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে ৭১৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিচ্ছে সরকার। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক দিচ্ছে ১৬৫ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংক ১৬৫ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংক ১৬৫ কোট এবং রূপালী ব্যাংক ১৬৫ কোটি টাকা জোগান দেবে। আর আইসিবি দিচ্ছে ৫৫ কোটি টাকা। এ বিপুল অঙ্কের অর্থ দিয়ে শেয়ার মূলধন বাড়াবে ফারমার্স ব্যাংক। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংকের একজন করে প্রতিনিধি বসানোর সম্ভাবনা আছে।
সম্প্রতি ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন জোগান সংক্রান্ত প্রস্তাবটি অনুমোদন দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অনুমোদনের পর বিষয়টি লিখিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে অবহিত করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। অনুমোদিত প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন সংগ্রহের ক্ষেত্রে মেজরিটি জোগানদাতা হবে সরকারি প্রতিষ্ঠান। এটি অনুমোদন করা হল।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংক বর্তমান যে অবস্থায় আছে, সেখানে এ টাকা বিনিয়োগ অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। এ অর্থ জনগণের, সরকারি ব্যাংকের। এ অর্থ একটি প্রাইভেট ব্যাংককে দেয়া মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যে কোনো প্রাইভেট কোম্পানি লোকসান হলে সরকার টাকা দিয়ে সেটি উদ্ধার করবে নাকি? এ ধরনের অবস্থা কোথাও হয়নি। হতে পারত যদি দেশের কোনো পরিস্থিতি বা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে অন্য কোনো কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো। এ ব্যাপারে তাহলে চিন্তা করা যেত। কিন্তু ফারমার্স ব্যাংক নিজেদের দোষের কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে অর্থ জোগান দেয়া মোটেও যৌক্তিক নয়। জনগণের এ টাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেয়া এবং অপচয়ের শামিল বলে মনে করছি আমি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংককে রক্ষা করা সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। নির্বাচনের আগে ব্যাংক দেউলিয়ার রেকর্ড সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না। যে কারণে এ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, ফারমার্স ব্যাংকে এ মুহূর্তে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। এরপর সরকারের নির্দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মূলধন জোগানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, সিদ্ধান্তটি এভাবে না নিলে ভালো হতো। এ ধরনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের অনুমতি নেয়া হলে ভালো হতো। কারণ ব্যাংকগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়ার পর, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া শোভন হয় না। তবে ব্যাংকগুলো যদি তাদের দেয়া অর্থের সমপরিমাণ শেয়ার পায় এবং ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তাদের প্রতিনিধি বসতে দেয় সেক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। এতে সরকারি ব্যাংকের লোকজন ফারমার্স ব্যাংককে রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে পারবে। কিন্তু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকের পদে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রতিনিধি দেয়া না হয়, সেক্ষেত্রে এ টাকা দেয়া সঠিক হবে না।

সূত্রমতে, ফারমার্স ব্যাংকের তারল্য সংকট প্রসঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এ ব্যাংক বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ব্যাংকের নীতি-নিয়ম পরিপালন না করে বেপরোয়াভাবে ঋণ প্রদান করেছে। অনুসরণ করা হয়নি ঋণ ও আমানতের অনুপাত। বিভিন্ন সময়ে দেয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাও পালন করা হয়নি। ফলে এ ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দেয় এবং বিরাজমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
সূত্রমতে, ফারমার্স ব্যাংকের বিরাজমান সংকট থেকে উদ্ধার করতে অর্থমন্ত্রীর কাছে মার্চ মাসে বিকল্প তিনটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান। প্রস্তাবগুলোর সারসংক্ষেপে তিনি বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন ১৫শ’ কোটি টাকা। বর্তমান পরিশোধিত মূলধন ৪শ’ কোটি টাকা। এ ব্যাংকে আরও ১১শ’ কোটি টাকা নতুন মূলধন জোগান দেয়ার সুযোগ রয়েছে। এ বাড়তি মূলধন দেয়া হলে ব্যাংকের ভিত্তি শক্ত হবে। পাশাপাশি দ্রুত তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে।

প্রস্তাব তিনটির প্রথমটি হচ্ছে- ফারমার্স ব্যাংকের মেজরিটি মূলধনের জোগান বেসরকারি খাত থেকে আসবে। সেক্ষেত্রে বেসরকারি খাত থেকে ৭শ’ কোটি টাকা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ৪শ’ কোটি টাকার জোগান দেয়া যেতে পারে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, মেজরিটি মূলধনের জোগানদাতা হবে সরকারি প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ৭শ’ কোটি টাকা এবং প্রাইভেট ইনভেস্টর থেকে ৪শ’ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেয়া যেতে পারে।
সর্বশেষ প্রস্তাবে বলা হয়, চারটি রাষ্টায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আইসিবি কর্তৃক শেয়ার ধারণের মাধ্যমে ৮০০-১১০০ কোটি টাকা অর্থাৎ পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধিতে যা প্রয়োজন তার সম্পূর্ণ অংশই জোগান দেয়া হবে। এক্ষেত্রে রেস ম্যানেজমেন্ট ফান্ড বিনিয়োগে আগ্রহী না থাকলে শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আইসিবি ফান্ড বিনিয়োগে সম্পৃক্ত থাকতে পারে।
সূত্র জানায়, এসব প্রস্তাব পাঠানোর পর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব দ্বিতীয় প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করেন অর্থমন্ত্রীর কাছে। সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়, দ্বিতীয় প্রস্তাবটি অনুমোদন হলে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক লিমিটেড এবং আইসিবি কর্তৃক শেয়ার ধারণের মাধ্যমে মূলধন জোগান দেয়া হবে। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংকের মধ্যে প্রতিটি ব্যাংকের মূলধন শেয়ার বাবদ অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৬৫ কোটি টাকা করে। পাশাপাশি আইসিবির মূলধন শেয়ার হবে ৫৫ কোটি টাকা।

জানা গেছে, ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন সংক্রান্ত প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রীর অনুমোদনের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সভাপতিত্বে এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে এ ব্যাংকের মেজরিটি মূলধনের জোগান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে নেয়ার সুপারিশ করেন গভর্নর বলেন, এতে পাঁচটি সুবিধা পাওয়া যাবে। এগুলো হচ্ছে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার ওপর গ্রাহকের আস্থা বাড়বে। পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
এছাড়া সরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা সক্রিয় অংশগ্রহণে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ভালো আর্থিক সূচকের দিকে ব্যাংকটি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। সরকারি ব্যাংকের অধীনে ফারমার্স ব্যাংক পরিচালনা হবে বিধায় মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ ফেরতকালে মিসম্যাচ হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। সর্বশেষ সুবিধা হিসেবে বলা হয়, ব্যাংকটির অবস্থা উন্নত হলে স্টক মার্কেটে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে সরকারি বিনিয়োগ উত্তোলন করাও সহজ হবে।

জানা গেছে, ২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া নয়টি ব্যাংকের একটি দ্য ফারমার্স ব্যাংক। ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭২৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
এ সময় পর্যন্ত ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ ছিল ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকার বেশি। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১৭১ কোটি টাকা। সে হিসাবে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫৫২ কোটি টাকা বা ৩২২ শতাংশ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/41160