২২ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, ১২:৪৩

ঝুঁকিতে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প

চীনের জেডটিই করপোরেশনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের দুটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অচলাবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ কারণে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বড় ঝুঁকিতে পড়বে। এ দুটি প্রকল্পেই বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ জেডটিইকে কম্পিউটিং ও সার্ভার সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি সরবরাহের কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক কোম্পানির।

গত ১৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্স ব্যুরো অব ইন্ডাস্ট্র্রি অ্যান্ড সিকিউরিটি এ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ডিজিটাল ব্যবস্থায় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় এ নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটি। এতে বলা হয়েছে- নিষেধাজ্ঞা জারির তারিখ থেকে ২০২৫ সালের ১৩ মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানিই চীনের জেডটিইর কাছে যন্ত্রপাতি বিক্রি করতে পারবে না। এখন পর্যন্ত বিশ্বে মাদারবোর্ড, চিপসেট, মাইক্রোপ্রসেসরের মতো কম্পিউটিং যন্ত্রপাতি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ছাড়া অন্য কোনো দেশের কোম্পানি তৈরিও করে না। ফলে জেডটিইর পক্ষে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি প্রকল্পে কম্পিউটিং যন্ত্রপাতি সরবরাহ বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়বে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের যেসব কোম্পানির সঙ্গে জেডটিইর যন্ত্রপাতি সরবরাহের চুক্তি আছে সেগুলোও সংকটে পড়তে পারে।
এ বিষয়ে ঢাকার চীনা দূতাবাসের ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস কাউন্সিলর লি গুয়াং তুন সমকালকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের পদক্ষেপে উদ্বিগ্ন চীন। একই সঙ্গে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে জেডটিই করপোরেশনের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পে বিরূপ প্রভাব এড়ানোর উপায় নিয়েও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে। গত রোববার চীনা দূতাবাসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সমকালের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এ নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। লি গুয়াং তুন আরও বলেন, চীন মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার বর্তমান বাস্তবতায় যথেষ্ট পেশাদারী মনোভাবের পরিচয় দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে জেডটিই করপোরেশনের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পে বিরূপ প্রভাব এড়ানোর উপায় নিয়েও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওই নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে মন্ত্রণালয় অবহিত এবং বিষয়টিতে তারা সচেতন রয়েছেন। ফোর টায়ার ডাটা সেন্টার প্রকল্পে যন্ত্রপাতি আগেই চলে আসার কারণে এ প্রকল্পে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু টেলিযোগাযোগ খাতের এমওটিএন প্রকল্পটি নতুন এবং এক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে কি-না, সে সম্পর্কে জেডটিইর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিষয়টিতে বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রের কাছে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ওই নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের প্রকল্প সংশ্নিষ্টদেরও কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পর যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি সেন্টার, এনসিএসসির এক প্রতিবেদনেও চীনের জেডটিই করপোরেশনের কাছ থেকে কেনা নেটওয়ার্ক ও ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি নিরাপত্তার জন্য হুমকি উল্লেখ করা হয়েছে। গত এক সপ্তাহে এনসিএসসির ওই প্রতিবেদন নিয়ে বিবিসিসহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় যা আছে : কমপক্ষে ছয়টি অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জেডটিই করপোরেশন বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক নিরাপত্তার শর্ত লঙ্ঘন করে আসছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির তৈরি কম্পিউটিং যন্ত্রপাতি ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের শর্ত ও নীতিমালার লঙ্ঘন করেছে। একই সঙ্গে তারা বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা একাধিক দেশেও গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির তৈরি করা কম্পিউটিং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছে। এ ছাড়া তাদের তৈরি নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতি একাধিক দেশে নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির তৈরি করা কম্পিউটিং যন্ত্রপাতি জেডটিই ব্যবহার করেছে। এ কারণে জেডটিইর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানি কোনোভাবেই জেডটিইর কাছে কম্পিউটিং যন্ত্রপাতি বিক্রি করতে পারবে না। একই সঙ্গে জেডটিইর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রফতানি সুবিধার সবকিছুই স্থগিত থাকবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানও জেডটিইর সঙ্গে কম্পিউটিং যন্ত্রপাতি সরবরাহ, সংগ্রহ, মজুদ কিংবা পরিবহন-সংক্রান্ত কোনো ধরনের চুক্তি বা সমঝোতায় যেতে পারবে না। জেডটিইর সঙ্গে অন্য কোনো ধরনের অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো প্রতিষ্ঠানের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে।
নিষেধাজ্ঞার প্রভাব : অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশ্বে টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ব্যবহূত সব ধরনের কম্পিউটিং যন্ত্রপাতি এখন পর্যন্ত কেবল যুক্তরাষ্ট্রের একক কোম্পনিই তৈরি করে। বিশেষ করে চিপসেট, মাইক্রোপ্রসেসর ও মাদারবোর্ডের মতো অতি সংবেদনশীল এবং মৌলিক যন্ত্রপাতি যুক্তরাষ্ট্রের কোয়ালোকম, ইনটেলের মতো একাধিক প্রতিষ্ঠানই বিশ্বজুড়ে সরবরাহ করে। অন্য কোনো দেশের কোম্পানি এ ধরনের কম্পিউটিং যন্ত্রপাতি বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহের রেকর্ড নেই। এ কারণে স্বাভাবিক নিয়মে চীনের জেডটিই বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তার প্রত্যেকটির জন্য মৌলিক কম্পিউটিং যন্ত্রপাতি যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক কোম্পানির কাছ থেকেই সংগ্রহ করে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বিটিসিএলের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার এমওটিএন প্রকল্প এবং তথ্য ও যোগাযেগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রায় এগারশ' কোটি টাকার ফোর টায়ার ডাটা সেন্টার প্রকল্প এককভাবে বাস্তবায়ন করছে চীনের জেডটিই করপোরেশন। এ দুটি প্রকল্পেই সব ধরনের মৌলিক কম্পিউটিং যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক কোম্পানির কথা কারিগরি বিবরণীতে উল্লেখ করেছে জেডটিই। এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের কোম্পানির কাছ থেকে সেসব যন্ত্রপাতি সংগ্রহ সম্ভব হবে না। ফলে দুটি প্রকল্পই সংকটে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, এমওটিএন প্রকল্প কেবল শুরুর পর্যায়ে রয়েছে। ফলে পুরো প্রকল্পই এখন বড় অনিশ্চয়তার মুখে। অন্যদিকে ফোর টায়ার ডাটা সেন্টার প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের পথে। কিন্তু এর মূল সার্ভারে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে। এখন কোনো যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। অন্য একটি সূত্র জানায়, ফোর টায়ার ডাটা সেন্টারে বেশ কিছু মৌলিক কম্পিউটিং যন্ত্রপাতি সংযোজনের কাজও এখন পর্যন্ত অসমাপ্ত রয়েছে। ফলে শেষ মুহূর্তে সংকটের আশঙ্কা এখনও আছে।
এ ব্যাপারে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার আরও বলেন, বিষয়টিকে তারা গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। ফোর টায়ার ডাটা সেন্টারে যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ আগেই শেষ হয়েছে। ফলে এ প্রকল্প নিয়ে সমস্যা হবে না; কিন্তু এমওটিএন প্রকল্পটি নতুন। ফলে এ প্রকল্পে যন্ত্রপাতি সরবরাহ সম্পর্কে জেডটিইর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। তাদের ব্যাখ্যা পাওয়ার পর এ সম্পর্কে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের একাধিক টেলিযোগাযোগ কোম্পানিও জেডটিইর কাছ থেকে নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতি নিচ্ছে। এসব নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতির মৌলিক কম্পিউটিং ইউনিটগুলোতেও যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির তৈরি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। ফলে বেসরকারি খাতের কোম্পানির সামনেও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ঝুঁকির সৃষ্টি করছে।
এ ব্যাপারে তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পরিসি ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, এ নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত। কারণ এ নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের প্রকল্প সংশ্নিষ্টদেরও যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।

 

 

http://samakal.com/bangladesh/article/18041276