২২ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, ১২:৪১

ভয়ংকর সড়কে নামাই দায়

রাজধানী ঢাকার সড়কগুলোর বেহাল সরেজমিনে দেখতে গতকাল শনিবার পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দীন রোডে যাওয়া হয়। দুপুর ১টা। চানখাঁরপুল মোড় হয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারমুখী ৬২ নম্বর সড়ক। সরু সড়কজুড়ে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। বিকল্প চলাচলের ব্যবস্থা নেই। পুরো সড়কে রাখা কাদা-মাটি। চলাচলের প্রায় অযোগ্য সড়কের এপার-ওপার ঘুরে পথচারীরা কোনোমতে চলছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে খোঁড়াখুঁড়িতে ভয়াবহ ভোগান্তিতে রয়েছে স্থানীয়রা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ড্রেনের উন্নয়নে প্রায় এক মাসের বেশি সময় ধরে চলছে এই খোঁড়াখুঁড়ি। সংস্কারকাজে ভোগান্তি ও চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও দ্রুত কাজ শেষ করার লক্ষণ নেই। বরং রাস্তা খুঁড়ে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এক দিন কাজ করলে বন্ধ থাকছে তিন দিন। রাস্তা ভর্তি ময়লা আর কাদা-মাটিতে চলাচল করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

দুপুর ১টা ১৫ মিনিট। শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ কেন্দ্রে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরছে কজন ছাত্রী। তিন ছাত্রী পরীক্ষার প্রশ্ন মেলাতে মেলাতে সামনের দিকে যাচ্ছে। রাস্তার দিকে যতটা মনোযোগ, তার চেয়ে বেশি প্রশ্নে। হঠাৎ একজন হোঁচট খেয়ে পড়ার উপক্রম। পাশের দুজন তাকে ধরে ফেলল। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, ‘আর কত্ত দিন লাগবে এই উন্নয়নকাজ শেষ করতে? পুরো রাস্তাই যদি বন্ধ থাকে, তাহলে চলব ক্যামনে?’
সরেজমিনে স্থানীয়দের ভোগান্তি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে যাওয়া এই প্রতিবেদক জানতে চাইলে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সীমা বলে, ‘দীর্ঘ সময় ধরে এই রাস্তার কাজ চলছে। পুরো রাস্তা ময়লা ফেলে বন্ধ রাখা হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে চারদিকে ছড়িয়ে বিশ্রী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ দীর্ঘ সময়েও কাজ শেষ হচ্ছে না। এই রাস্তা দিয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা কেউ ভাবে না।’

পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দীন রোড অপেক্ষাকৃত নিচু। চানখাঁরপুল মোড় থেকে সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দিয়ে রাস্তাটি মিলেছে পুরান ঢাকায়। পণ্য আনা-নেওয়া ও ব্যবসার কারণে রাত-দিন সব সময় মানুষের আনাগোনা বেশি থাকে। তবে বৃষ্টি হলে রাস্তায় পানি জমে যায়। চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। সম্প্রতি জলাবদ্ধতার ভোগান্তি কমাতে ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশের মোড় থেকে চানখাঁরপুল মোড়গামী ওই সড়কে ড্রেনের উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছে। পুরো রাস্তা নয়, অর্ধেক রাস্তা খুড়ে ড্রেনের রিং বসানোর কাজ চলছে। পানি চলাচলের ব্যবস্থা করতে খোঁড়া মাটি রাখা হচ্ছে রাস্তার ওপর। একদিকে রাস্তা খোঁড়া, অন্যদিকে মাটি রাখায় চলার অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে নাজিমুদ্দীন রোডের ৬২ নম্বর সড়কটি। এতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী ও স্থানীয়রা পড়েছে চরম ভোগান্তিতে।

সরেজমিনে শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ পার হয়ে সামনে এগোলে বেগম সুফিয়া বিদ্যানিকেতন। এই নিকেতনের নিচে রাস্তার ওপর রাখা হয়েছে ময়লার কনটেইনার। আশপাশেও ছড়িয়ে রয়েছে ময়লা। উৎকট গন্ধে নাক ধরেই চলতে হচ্ছে পথচারীদের। একটু সামনে এগিয়ে বাঁ পাশে নিউ আনন্দ ফার্নিচার। এই ফার্নিচার দোকানের সামনের রাস্তায় রাখা হয়েছে ইট। মাটির নিচে স্থাপনের জন্য তৈরি করা রিং ওপরে রাখায় চলার পথ বন্ধ।
স্থানীয় লোকজন বলছে, রাস্তার খোঁড়াখুঁড়িতে ভোগান্তিতে পড়েছে স্থানীয় মানুষ। রাস্তা বন্ধ রেখে কাজ করায় চলাচল কঠিন হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বিকল্প ব্যবস্থায় অন্য রাস্তা হয়ে বাসায় ফিরছে। মানুষের যাতায়াত কম থাকায় ব্যবসায়ীদের ওপরও প্রভাব পড়ছে। বেচাকেনা কমে গেছে—এমন মন্তব্যও অনেকের। তবে নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে ক্ষোভ অনেকের।

চায়ের দোকান চালিয়ে সংসার চালান শাজাহান। নাজিমুদ্দীন রোডের পাশের গলিতে ছোট দোকানের তিন পাশে তিনটি বেঞ্চ। দোকানে কোনো মানুষ নেই। জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, পুরান ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এই নাজিমুদ্দীন রোড। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারে না; যার জন্য দোকানে বিক্রিও কম। আগে দম ফেলার সময় থাকত না। এখন বিক্রি অনেক কমে গেছে।
নিরব হোটেলের নিচের এক দোকানদার কালের কণ্ঠ’র কাছে নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, প্রায় এক মাসের বেশি সময় ধরেই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। রাস্তার এক পাশ খুঁড়ে সিমেন্টের পাইপ বা রিং বসানো হচ্ছে। আর রাস্তা খোঁড়া কাদামাটি রাখা হয়েছে আরেক পাশে। এতে দুই পাশই বন্ধ হয়ে গেছে। চলাচল করা যায় না।

নির্মাণে বিলম্বের বিষয় উল্লেখ করে ওই ব্যক্তি বলেন, এই রাস্তায় রিং বসানোর কাজ হয় এক দিন কিন্তু বন্ধ থাকছে তিন দিন। মানুষের ভোগান্তি হলেও দ্রুত কাজ হচ্ছে না। ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতি করতে গিয়ে মানুষের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই অতিদ্রুতই নির্মাণকাজ শেষ করা উচিত।
জিগাতলা ট্যানারি মোড়
জিগাতলার ট্যানারির মোড়ে তিন মাজার রোডের এক পাশে কাঠের আসবার তৈরির দোকান। অন্য পাশে রং ও চামড়ার ব্যাগ, বেল্ট-জুতার দোকান। রাস্তাটির এক পাশে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। মূলত ড্রেনের কাজ করতেই এই খোঁড়াখুঁড়ি। যদিও ঝকঝকে এই রাস্তার উপরিভাগে কোনো সমস্যা চোখে পড়ে না।
গতকাল সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয় দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন দিন ধরে রাস্তার এক পাশের অংশে কাজ শুরু হয়েছে। পাকা রাস্তা ভেঙে এবং মাটি খুঁড়ে সেগুলো রাস্তার ওপরই রাখা হচ্ছে। তবে এই কদিনে মাত্র এক থেকে দেড় মিনিটের হাঁটা রাস্তা পর্যন্ত খোঁড়া হয়েছে। খোঁড়াখুঁড়ির সামনে পড়া জনতা পেইন্ট অ্যান্ড হার্ডওয়্যার স্টোরের বিক্রেতা আব্দুল কালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তিন দিন ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। বেশি খোঁড়া হয়নি বলে ক্রেতারা আসতে পারছে। পুরো রাস্তা খোঁড়া হয়ে গেলে ক্রেতারা আর দোকানে আসতে পারবে না।’

আর খোঁড়াখুঁড়ি করে রাস্তার ওপর সব কিছু রাখায় রাস্তার এক-তৃতীয়াংশ জায়গা দখল হয়ে গেছে।
মোহাম্মদপুর- লালমাটিয়া-ধানমণ্ডি ২৭ সংস্কারের নামে মোহাম্মদপুরের অলিগলি, সড়ক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। একইভাবে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে লালমাটিয়া হয়ে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়ক পর্যন্ত রাস্তা চলাচলের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়কে এক মাসের ওপর ধরে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ায় ওই এলাকা ঘিরে চারপাশে প্রতিদিন ভয়াবহ যানজট তৈরি হয়।

শেওড়াপাড়া-মিরপুর এলাকা
২০১৫ সালের এপ্রিলে শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে ৬০ ফুট পর্যন্ত সড়কটি প্রায় দুই সপ্তাহ বন্ধ রেখে ওয়াসার পাইপ বসানো হয়েছিল। ওই সময় বন্ধ ছিল রিকশা চলাচলও। রাস্তার নিচে আগে কংক্রিটের ২৪ ফুট চওড়া পাইপ বসানো হয়েছিল, যাতে রাস্তায় পানি জমে না থাকে। তাতে ফল হয়নি। ওই পাইপ সরিয়ে ৩৬ ফুট চওড়া পাইপ বসানো হয়েছে। কাটা হয়েছে ১১৫ ফুট রাস্তা। দুই বছর পর গতকালও এই সড়কে ওয়াসার পাইপ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
মধ্য পীরেরবাগ, দক্ষিণ পীরেরবাগ, পশ্চিম শেওড়াপাড়া, পাশের নতুন ৬০ ফুট সড়কের স্থানে স্থানে ওয়াসাসহ বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ভালো সড়কও নষ্ট হয়ে গেছে। শেওড়াপাড়ার পীরেরবাগে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ শেষ হয়েছে। তবে তাও ভাঙতে শুরু করেছে বিভিন্ন স্থানে।
জানা গেছে, আবারও আরো চওড়া পাইপ বসানোর প্রস্তুতি চলছে। এভাবে বিভিন্ন এলাকায় বারবার সড়ক খোঁড়াখুঁড়িতে নির্মাণ ব্যয় বাড়লেও সড়ক টিকছে না। দুই সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি একটি সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।


 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/04/22/627842