২২ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, ১২:১১

মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭

বাংলাদেশে সভা সমাবেশ সীমিত করেছে সরকার

সংবাদপত্র ও বাকস্বাধীনতা সীমাবদ্ধ * বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের অভিযোগ * রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র

বাংলাদেশের আইনে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকার দেয়া হলেও সরকার তা সীমিত করেছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলাহয়েছে। এতে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও কড়া সমালোচনা করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন,বেআইনি আটক, গুম ও নাগরিক স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ আরোপের অভিযোগ তোলা হয়েছে।
আরও বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে দেশে বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রেরস্বাধীনতা ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা ছিল সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে সরকার সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করছে বলেও এতেউল্লেখ করা হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের বার্ষিক কংগ্রেশনাল-ম্যান্ডেটেড হিউম্যান রাইটস রিপোর্টে এসব কথা বলা হয়। স্থানীয় সময় শুক্রবার দেশটিরভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন জে সালিভান এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাসহ সংবিধানে বাকস্বাধীনতার অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার অনেক সময় এ অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাজানাতে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক সাংবাদিক হয়রানি ও রোষানলের ভয়ে সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে ‘স্বআরোপিত সেন্সরশিপ’ করছেন।
এতে বলা হয়- অনেক মুক্ত সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রভাবে প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করাহচ্ছে। বেসরকারি কোম্পানিগুলোকেও বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করতে এসব সংস্থা চাপ দিচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে সরকার বিজ্ঞাপনকে একটি অস্ত্র হিসেবেব্যবহার করছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার আইনে থাকলেও সরকার তা সীমিত করেছে।কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সভা-সমাবেশ করতে হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বিচার বিভাগ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আইনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকলেও ‘দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে’ তা কার্যকর হচ্ছে না।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েনের মধ্যে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগের প্রসঙ্গও এসেছে প্রতিবেদনে। ওই বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরের (২০১৭ সাল) শেষ দিকে সরকার প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ উত্থাপন করতে থাকে। আরসরকারের এসব কথাবার্তাকে মানবাধিকার নিয়ে কর্মরতরা রাজনৈতিক অভিসন্ধিপূর্ণ বলে অভিযোগ করেছেন।
মানবাধিকার কর্মীদের বরাত দিয়ে এতে অভিযোগ করা হয়, সরকারি কৌঁসুলি ও আদালতের কর্মকর্তারা অনেক আসামির কাছে ঘুষ দাবি করেন। ঘুষ যারাচাচ্ছেন তাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

প্রতিবেদনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উল্লেখ করেছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মানবাধিকার ইস্যু ছিল সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, বেআইনি আটক ও গুম এবং নাগরিক স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ।এতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানানো হয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, গত বছর ১৬২ জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’নিহত হয়েছেন। আর রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ৪৪ জন। এছাড়া মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাবে গত বছরের প্রথম ১০ মাসে ১১৮জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্যাতনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়মুক্তি পাচ্ছে। বাহিনীর হাতে হত্যা ও নিপীড়নের ঘটনায় সরকার তদন্ত ওবিচারের পদক্ষেপ নিয়েছে খুব কম। পুলিশ ও নিরাপত্তা সেবার প্রতি জনগণের অবিশ্বাসের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সহযোগিতা চাওয়াবা অপরাধের ঘটনার খবর জানানোর প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে।
জবাবদিহিতার ঘাটতির কারণে মতপ্রকাশ, সংবাদ মাধ্যম ও এনজিও কর্মকাণ্ডে বাধা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের স্বাধীনতায় বাধা, দুর্নীতি, লিঙ্গ, ধর্ম,বর্ণ, উপজাতি, যৌনাচার ও লিঙ্গ পরিচয়ভিত্তিক বৈষম্য বিরাজ করছিল। মানব পাচার গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে রয়েছে। এছাড়া শ্রমিকদের অধিকারে বাধাএবং শিশুশ্রম রয়েছে মারাত্মকভাবে।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। দৃশ্যত তা আন্তর্জাতিক সহিংস চরমপন্থা দ্বারাঅনুপ্রাণিত। এছাড়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ১১ নভেম্বরের একটি সংবাদের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
ওই খবরে বলাহয়েছে- ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে দেয়া ফেসবুক পোস্টের গুজবে রংপুরে স্থানীয় মুসলমানরা ৩০টি হিন্দু বাড়ি ভাংচুর ও জ্বালিয়ে দেয়। এনজিওদের মতে,বাংলাদেশে বর্ণ ও ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলো বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, অনেক দলিতের (নিম্নবর্ণের হিন্দু) ভূমি, পর্যাপ্ত আবাসন, শিক্ষা ওকর্মসংস্থানের সুবিধাবঞ্চিত।

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়েও উল্লেখ করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিফিংয়ের সময় বলেন, এ ঘটনায় দায়ীদের অবশ্যই শাস্তি পেতেহবে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানো হয়েছে, আমরা তার নিন্দা জানাই। এ সংকট সমাধানে আমরা আমাদের সহযোগীদের সঙ্গেকাজ করছি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/40760