২১ এপ্রিল ২০১৮, শনিবার, ১২:৩৫

ভোগান্তির আরেক নাম ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক

৮-১০ ঘণ্টার আগে গন্তব্যে পৌঁছা যায় না

ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে গাজীপুর হয়ে ময়মনসিংহ পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে গাড়িতে যেতে সর্বোচ্চ ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘণ্টার বেশি লাগার কথা না। কিন্তু ওই গন্তব্য পৌঁছতেই এখন যেকোনো গাড়িতেই ১০ ঘণ্টার মতো লেগে যাচ্ছে। কখনো কখনো এই সময় আরো বেশি লাগছে।
এতে এ পথে যাতায়াতকারী হাজার হাজার মানুষকে প্রতিদিন বেশির ভাগ সময় গন্তব্য পৌঁছার আগে গাড়ির মধ্যে ঠায় বসে থাকতে হয়।
শুধু যাত্রীবাহী বাস, মিনিবাস, মাইক্রো অথবা প্রাইভেট কার নয়, হাজার হাজার মালবোঝাই ট্রাকগুলোকেও বসে থাকতে হচ্ছে। জ্যামের এই চিত্র এখন দিন রাতের ভোগান্তিতে রূপ নিয়েছে। যদিও জয়দেবপুর মোড় থেকে ময়মনসিংহ সড়ক পর্যন্ত পুরোটাই এখন চার লেনে রূপান্তর হয়েছে। তার পরও কেন এবং কী কারণে প্রতিদিন এ পথের মানুষকে যানবাহনের ভেতরে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।
সরেজমিন ঢাকা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা হয়ে ময়মনসিংহ প্রধান শহর পর্যন্ত খোঁজ নিতে গেলে পাওয়া যায় এসব চিত্র।
বাসের চালকেরা বলছেন, টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত পৌঁছতেই এখন তিন-চার ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। এতে তাদের এক দিনের ট্রিপে যে টাকা আয় করার কথা সেটি দুই দিনে গড়িয়ে যাচ্ছে। এতে এক দিকে গাড়ির মালিক যেমন লোকসান গুনছেন, তেমনি যাত্রীদের সাথে চালকদের প্রায় বচসা হচ্ছে।
গত বুধবার ভোর ৮টায় ঢাকার গুলিস্তান থেকে মাইক্রোবাস ছেড়ে যায় ময়মনসিংহের উদ্দেশে। এর মধ্যে মগবাজার মোড়ে খুব একটা যানজট না হলেও নাবিস্কো-মহাখালী এলাকায় কিছুটা যানজটে পড়তে হয়। এরপর বিমানবন্দর সড়ক পার হওয়ার পরই উত্তরা-আবদুল্লাহপুরে যানজটে পড়তে শুরু করে একের পর এক গাড়ি। উত্তরা থেকে আবদুল্লাহপুর হয়ে টঙ্গী মূল রাস্তা পর্যন্ত যেতে বেলা সাড়ে ১০টা বেজে যায়। এরপর থেকেই গাড়ি চলতে থাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তার পরও বেশির ভাগ ভাঙা রাস্তা পার হয়ে বেলা সাড়ে ১১টায় গাড়িটি গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়। যারাই গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত পৌঁছতে পারছেন তারাই হাফ ছেড়ে বাঁচছেন। এরপরই নবনির্মিত ফোর লেনে দ্রুতগতিতে গাড়ি চলে যাচ্ছে ময়মনসিংহ পর্যন্ত। কিন্তু ওই দিন বিকেলে ময়মনসিংহ টাইম স্কয়ার চড়পাড়া মোড় থেকে আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেও ওই গাড়িটি ঢাকায় পৌঁছে রাত ২টায়। তার মানে ঢাকায় পৌঁছতে ১০ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ফেরার সময় গাজীপুর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের ময়মনসিংহ সড়কে হাজার হাজার ট্রাক জ্যামে আটকে পড়ে। আর মাইক্রো নিয়ে গাজীপুর চৌরাস্তা পার হয়ে টঙ্গী চেরাগআলী পর্যন্ত আসতেই সময় লাগে চার ঘণ্টার মতো। এরপর আবদুল্লাহপুর-উত্তরা হয়ে ঢাকায় পৌঁছতে রাত ২টা ১০ মিনিট লেগে যায়। এই যাওয়া আসার সময় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয় টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত। এরপর ভোগান্তি নাই বললেই চলে।
এ প্রসঙ্গে মাইক্রোচালক দুলাল এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি সারা দেশে গাড়ির ট্রিপ নিয়ে যাই। তবে পারত পক্ষে এই সড়কে আসি না। যেমন আজ এসে আবার শিক্ষা হলো। আমি আগামীতে আর এই পথে কোনো ট্রিপ নিয়ে আসব না। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এসব স্থানে কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যের কার্যক্রম আমার চোখে পড়েনি। ময়মনসিংহ যেতে যদি এখনো ১০ ঘণ্টা লাগে তাহলে হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফোর লেন বানিয়ে কি লাভ হলো?
আমাদের টঙ্গী প্রতিনিধি আজিজুল হক জানান, গতকাল টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কে যানজট ছিল চরমে। তিনি বলেন, টঙ্গী থেকে চেরাগ আলীর রাস্তার দুই পাশে শত শত ট্রাক কোনো কারণ ছাড়াই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। এটা যানজটের একটা কারণ। দ্বিতীয়ত টঙ্গী বাজার থেকে ভোগড়া বাইপাস পর্যন্ত অটোরিকশা, ইজিবাইক ছাড়াও ধীরগতিতে গাড়ি চলাচলের কারণে যানজট ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব গাড়ি চলাচলে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তার পরও ‘পুলিশ প্রশাসনকে’ ম্যানেজ করে দিব্যি চলাচল করছে অনায়াসে এসব গাড়ি। তার মতে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ শহরের দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। এই পথ পাড়ি দিতে সর্বোচ্চ আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লাগার কথা। কিন্তু এখন জয়দেবপুর থেকে টঙ্গী আসতেই লেগে যাচ্ছে তিন-চার ঘণ্টা। আবার কখনো পাঁচ ঘণ্টাও। দীর্ঘ দিন ধরে এই পথে নানা পেশার যাত্রীরা হয়রানি হলেও কর্তৃপক্ষ বলছেন ভিন্ন কথা। আজিজুল হক এ প্রতিবেদককে আরো একটি কারণ উল্লেখ করেন। সেটি হচ্ছে টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ‘বাস র্যাপিড ট্রানজিট’ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় সড়কের দুই পাশের রাস্তায় ড্রেনের কাজ শুরু হয়েছে। বিআরটি এর প্রজেক্ট ডিরেক্টর কিছুদিন আগে যানজট প্রসঙ্গে বলেছেন এটা হচ্ছে ‘প্রসবকালীন যন্ত্রণা’। যখন এই পথের কাজ শেষ হয়ে যাবে তখন আর এই পথে চলাচলকারী লোকজনকে ভোগান্তি পোহাতে হবে না। তবে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হতে কত দিন লাগবে তা নিয়ে সন্দেহের মধ্যে পড়েছেন গাজীপুর ও উত্তরবঙ্গবাসী। ওই এলাকার মানুষের মতে, তাদের এই ভোগান্তি আগামী কয়েক বছর ধরে সহ্য করতে হতে পারে। কারণ এই ১২ কিলোমিটার সড়কের কাজ শেষ হওয়ার পর আবদুল্লাহপুর ও টঙ্গীর মধ্যে যে একাধিক ব্রিজ নির্মাণ হচ্ছে, সেটির পর শুরু হবে নতুন ভোগান্তি। এখানে ৮ লেনের সড়ক হবে।
গতকাল বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের পরিচালক মো: সানাউল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত যে ভয়াবহ যানজট হচ্ছেÑ এটা শুধু আমার প্রকল্প শুরুর কারণে হচ্ছে, তা কি ঠিক? এর আগে কি হতো না? তিনি বলেন, এই সড়কের রাস্তার ক্যাপাসিটি শুধু অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তা ছাড়া আন অথারাইজ যানবাহন চলাচল ও বর্ষার কারণে বৃষ্টির পানি না সরাও অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, পুলিশ প্রশাসন আমাদের সার্বক্ষণিকভাবে সহযোগিতা করছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি কিন্তু আজ (শুক্রবার) মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে টঙ্গী থেকে গাজীপুর যেতে পেরেছি। এখন অফিস টাইমে এক থেকে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না। আমার প্রকল্প শুরু হওয়ার আগে এই রাস্তা পার হতে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা সময় লাগত। আমার প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের জুনে শেষ হবে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/312017