২০ এপ্রিল ২০১৮, শুক্রবার, ৮:২৭

উন্নয়ন ব্যয়ের বড় অংশ অপচয় ও লুটপাটে যাচ্ছে : বিশেষজ্ঞ মত

লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সড়ক উন্নয়ন ব্যয়

সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বিশেষ করে মহাসড়কগুলোকে চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের ব্যয় লাফিয়ে বাড়ছে। ব্যয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে গতি অনেক। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ও জাতীয় এই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ঢিমেতালে চলছে। আর এতে জনদুর্ভোগও বাড়ছে বছরের পর বছর ধরে। যানজট নিরসন এবং মানুষের দুর্ভোগ কমাতে দেশের মহাসড়কগুলোকে চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। উল্টো বাড়ছে জনদুর্ভোগ ও প্রকল্প ব্যয়। জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল টু এলেঙ্গা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের ব্যয় দুই হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে পাঁচ হাজার ৫৯৩ কোটি ১৪ লাখ টাকায় দাঁড়াচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সংশোধন প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়ন ব্যয়ের একটা বড় অংশ অপচয় ও লুটপাটে যাচ্ছে। যার কারণে এসব কোনো কাজে আসবে না। শুধু ঋণের বোঝাই বাড়বে।

জয়দেপুর-চন্দ্রা হয়ে টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয় ২০১৩ সালের এপ্রিলে। সাসেক রোড কানেকটিভিটি প্রজেক্ট ইমপ্রুভমেন্ট জয়দেবপুর, চন্দ্রা-টাঙ্গাইল এ্যালেঙ্গা রোড টু-এ-লেন হাইওয়ে প্রজেক্ট নামে এই প্রকল্পটি এখন থমকে আছে। নকশার ত্রুটি সংশোধনের নামে কাজ শুরুর আগেই ২৭৮ কোটি টাকা শেষ হয়ে যায়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), আবুধাবি ফান্ড ও ওপেক ফান্ড মিলে এতে মোট এক হাজার ৮৪৩ কোটি ৬৮ লাখ ২১ হাজার টাকার ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।

এ পর্যন্ত এই প্রকল্পের ব্যয় দুই দফায় বাড়ানো হয়েছে। প্রথম দফায় সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে তিন হাজার ৬৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা করা হয়। এরপর এই ব্যয় আবারো বাড়িয়ে তিন হাজার ৩৬৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা করা হয়। প্রকল্পটি গত মার্চের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল।

জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে এখন আবার নতুন করে দুই হাজার ২২৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এতে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে পাঁচ হাজার ৫৯৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, দুই বছর বাড়ছে বাস্তবায়নের সময়কালও। চলতি বছরের মার্চে সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও এখন ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক মো: ইসহাকের সাথে গত রাতে কথা হলে তিনি জানান, রাস্তার একপাশে এসএমভিটি লেন, অতিরিক্ত ফাইওভার, ১৩টি আন্ডারপাস ও যাত্রী শেড নির্মাণ এবং রাজস্ব খাতে যানবাহন রেজিস্ট্রেশন ফি, বিদ্যুৎ বিল, এনভায়রনমেন্ট কিয়ারেন্স ফিসহ বিভিন্ন ফি বৃদ্ধির কারণে ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ হলো, বিদ্যমান ৭০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ককে ২ লেন হতে ৪ লেনে উন্নীতকরণ, সড়ক নিরাপত্তা উন্নয়ন এবং নির্বিঘেœ যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ধীরগতি সম্পন্ন যানবাহনের জন্য আলাদা লেন নির্মাণ, প্রকল্প সড়কের ইন্টারসেকশন এবং রেলওয়ে ক্রসিংয়ে যানজট দূরীকরণের জন্য প্রকল্প সড়কে পাঁচটি ফাইওভার নির্মাণ, প্রকল্প সড়কে ২৬টি সেতু এবং ৬০টি কালভার্ট নির্মাণ এবং ৭০ কিলোমিটার মহাসড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে সড়ক নিরাপত্তা উন্নয়ন। তিনি বলেন, চন্দ্রা পর্যন্ত ধীর গতি যানের জন্য একটি লেন ছিল। আন্তর্জাতিক মানের করার লক্ষ্যে এর পুরোটাই দুই পাশে ধীরগতির যানের জন্য লেন করতে হবে। এ ছাড়া ভূমি অধিগ্রহণে কত সময় লাগবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তাই সময় বাড়াতে হয়েছে।

ভৌত অবকাঠামো বিভাগ বলছে, এই প্রকল্পের আওতায় জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কটি উভয়পাশে এসএমভিটি লেনসহ ছয় লেনে উন্নীতকরণ হলে দেশের উত্তরাঞ্চলের সাথে রাজধানীর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ এই মহাসড়কাংশ ব্যবহার করে ভবিষ্যতে বাংলাবান্ধা দিয়ে ভারত ও নেপাল এবং বুড়িমারি দিয়ে ভারত ও ভুটানের সাথে উপ-আঞ্চলিক সড়ক সংযোগ সহজতর হবে। একই সাথে জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে।

আইএমইডির পরিদর্শন কর্মকর্তাদের অভিমত, সঠিক সময়ে প্রকল্প অনুমোদন দেয়ার পরও সময় মতো দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে কাজ শুরু না করার কারণে প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে যায়। ফলে ব্যয় বাড়ছে এবং প্রকল্পগুলো বছরের পর বছর এডিপিতে টানতে হচ্ছে। সড়ক খাতের প্রকল্প এমনও রয়েছে যেগুলো ১০-১২ বছর ধরে চলছেই। কোনো ভাবেই এর সমাপ্তি হচ্ছে না। চার ও আট লেনের প্রকল্পগুলো যথাসমেয় শেষ না হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে এবং সামনে বর্ষা মওসুমে এ দুর্ভোগ আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের েেত্র দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে অর্থ অপচয় বন্ধ করতে বিভিন্ন প্রকল্প কার্যক্রম নিয়মিত সরেজমিন পরিদর্শন করা দরকার। কিন্তু এসব করা হচ্ছে না। অনেক প্রকল্প সরেজমিন দেখার ও সুযোগ হয় না।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুজন সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, বিদেশ থেকে ঋণ এনে আমরা উন্নয়ন কার্যক্রম করছি। কিন্তু এগুলো থেকে দেশের সাধারণ মানুষ কোনো সুফল পাচ্ছে কিনা সন্দেহ আছে। এই ঋণের দায় প্রতিটি মানুষের ওপর পড়ছে। তিনি বলেন, উন্নয়ন ব্যয়ের একটা বড় অংশ অপচয় ও লুটপাটে যাচ্ছে, যার কারণে এসব কোনো কাজে আসবে না। শুধুই জনদুর্ভোগ। ভবিষ্যতে এই ঋণ আমাদের জন্য গলার ফাঁসে পরিণত হবে। তিনি বলেন, নতুন ঋণদানকারী দেশ ও সংস্থাগুলো কোনো ছাড় দেবে না। আমাদের এখানে সড়ক খাতে যে ব্যয় হয় তা এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তিনি বলেন, আমাদের এখানে শ্রমের মূল্য কম, জনবল আছে। সেখানে কেন এত বেশি ব্যয় হবে?

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/311748