২০ এপ্রিল ২০১৮, শুক্রবার, ৮:১৮

ঢাবি ক্যাম্পাসজুড়ে ভীতি

কোটা সংস্কার আন্দোলন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসজুড়ে বিরাজ করছে ভীতিকর পরিবেশ। কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক ও অস্থিরতা। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক কোটাব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল ঘোষণা করার পর যেখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দ বিরাজ করার কথা সেখানে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক শিক্ষার্থী বর্তমানে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থী যারা এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানা গেছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে এত বড় সফলতার পরও অনিশ্চয়তা আর আতঙ্ক ঘিরে আছে শিক্ষার্থীদের। বিভিন্ন কারণে পরিস্থিতি নেতিবাচক দিকে মোড় নিচ্ছে বলে মনে করেন অনেক শিক্ষার্থী। অনেক শিক্ষার্থী রাতে আবাসিক হলে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবস্থান করতে পারছেন না ভয়ের কারণে। কখন কোন পক্ষ থেকে ডাক পড়ে আর হুমকি ধামকি দেয়া হয় এ নিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। শিক্ষার্থীরা কোথাও পরস্পর মিলিত হওয়া মাত্রই তাদের আলোচনায় স্থান পাচ্ছে কোটা আন্দোলন-পরবর্তী ভীতিজনক পরিস্থিতি। কেউ কোটা আন্দোলন-পরবর্তী নেতিবাচক পরিস্থিতি এড়িয়ে থাকতে পারছেন না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও নির্বিকার ভূমিকা পালনের অভিযোগ উঠেছে।

কয়েকটি কারণে ঢাবি ক্যাম্পাসে বর্তমানে ভীতি আর নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান এশার ওপর থেকে সব ধরনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়া। এশাকে হেনস্তাকারী হিসেবে কবি সুফিয়া কামাল হলের ২৬ ছাত্রীর তালিকা তৈরি এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি। ভিসি ভবনে হামলাসহ বিভিন্ন ঘটনায় চারটি মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা এবং মামলা প্রত্যাহার না করা। কোটা আন্দোলনের তিন যুগ্ম আহ্বায়ককে গত সোমবার ডিবি কার্যালয়ে তুলে নেয়া। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা প্রজ্ঞাপন অথবা গেজেট আকারে প্রকাশে বিলম্ব এবং ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নজরদারিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড।

এ পরিস্থিতিতে মামলা প্রত্যাহারের জন্য গত বুধবার কোটা আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে সাত দিনের আল্টিমেটাম ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যথায় আবারো ছাত্রধর্মঘটসহ আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। এ আল্টিমেটাম ঘোষণার সময়ও নেতৃবৃন্দ তাদেরসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের তীব্র নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি তুলে ধরেন।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নূর বলেন, আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের নানা রকম ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আমরা সবাই জীবননাশের শঙ্কায় আছি। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমাদের খেয়ে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে। তাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এবং সক্রিয় ভূমিকা পালনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অনুরোধ করছি।

শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলার কারণে সাধারণ শিার্থীরা হয়রানির আশঙ্কা করছেন। কারণ অজ্ঞাতনামা মামলায় যে কাউকে হয়রানি করা যায়।
গত ১৩ এপ্রিল ছাত্রী নির্যাতনকারী এশার ওপর থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় ছাত্রলীগ। এরপর গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা জানায়। এরপর থেকে ক্যাম্পাসজুড়ে আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয় এ বিষয়টি। বিশেষ করে কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রীদের মধ্যে নেমে আসে চরম আতঙ্ক। বিরাজ করে এক ধরনের হিমশীতল নীরবতা। কারণ ১০ এপ্রিল মধ্য রাতে এশার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই হলের প্রায় সব শিক্ষার্থীই রুম থেকে বের হয়ে এসে এশার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং তার বিচার দাবি করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত ১০ এপ্রিল গভীর রাতে ইফফাত জাহান এশার বিরুদ্ধে এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দেয়াসহ ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগের খবর ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাসে। এক ছাত্রীর রক্তাক্ত কাটা পায়ের ছবি শেয়ার হতে থাকে ফেসবুকে। এতে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো ক্যাম্পাস। এ নিয়ে রাত ১২টা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত উত্তাল পরিস্থিতি বিরাজ করে ক্যাম্পাসে। কবি সুফিয়া কামাল হলের সাধারণ ছাত্রীরা হলের সামনে জড়ো হন। এ ছাড়া বিজয় একাত্তর হলসহ বিভিন্ন হলের আবাসিক ছাত্ররা গভীর রাতে হলের গেট ভেঙে মিছিলসহকারে কবি সুফিয়া কামাল হলের সামনে জড়ো হন। পরিস্থিতির এক পর্যায়ে কবি সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থীরা এশাকে ধরে এনে গলায় জুতার মালা পরায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে এশাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে। ছাত্রলীগও তাকে কমিটি থেকে বহিষ্কার করে।

ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগ এবং সাধারণ শিক্ষার্থী কর্তৃক তার গলায় জুতার মালা পরানোর খবরে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ১২ এপ্রিল ছাত্রলীগ তদন্ত কমিটি গঠন করে। ১৩ এপ্রিল এশাকে নির্দোষ ঘোষণা করে তার বিরুদ্ধে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যহার করে নেয় ছাত্রলীগ। আর গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ওই রাতে পায়ের রগ কাটার কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাই এশার বিরুদ্ধে বহিষ্কারাদেশও প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

এ দিকে কবি সুফিয়া কামাল হল কর্তৃপক্ষ এশাকে হেনস্তাকারী হিসেবে ২৬ ছাত্রীর নাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জমা দিয়েছে। ঢাবি ভাইস চ্যান্সেলর ড. মো: আখতারুজ্জামান গত বুধবার এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ইফফাত জাহান এশা কেন্দ্রিক খবরে কবি সুফিয়া কামাল হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরাজ করছে এক ভীতির পরিবেশ।

এ দিকে কবি সুফিয়া কামাল হল শাখার ছাত্রলীগ সভাপতি ইফফাত জাহান এশার বহিষ্কারাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপ তুলে নেয়ার প্রতিবাদে গতকাল মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা। ‘নিপীড়নবিরোধী শিার্থীবৃন্দ’র ব্যানারে টিএসসির সামনে রাজু ভাস্কর্য চত্বরে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘ক্যাম্পাস নাকি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’, ‘নিপীড়ক মুক্ত ক্যাম্পাস চাই’, ‘গেস্টরুম ভেঙে ফেল, আর কত চুপ থাকবেন’, ‘আমরা সবাই কানা, এই কানার রাজত্বে’, প্রভৃতি লেখা পোস্টার বহন করেন।

এ সময় একজন ছাত্র বলেন, এশাকে শুধু রগ কাটার অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়নি। তাকে হলের ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করার অপরাধেও বহিষ্কার করা হয়েছিল। এসব কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে সে সময় সাাৎকারে বলেছেন; কিন্তু এখন আমরা কি দেখতে পেলাম। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপ তার ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমরা প্রশাসনের একপীয় এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাই।

আরেক ছাত্রী বলেন, ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকে ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই হামলার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি। সুফিয়া কামাল হলের নেত্রী শিার্থীদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালায়। সুফিয়া কামাল হলের ত্রাস এশা। ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল; কিন্তু প্রশাসন প্রহসনের মাধ্যমে আবার তার ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন ধরনের নজরদারিমূলক কর্মকাণ্ডের কারণেও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মধ্যে বর্তমানে ভীতি বিরাজ করছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাবি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি চত্বর। শিক্ষার্থীরা জানান, বর্তমানে প্রতিদিন ঢাবি ছাত্রলীগ শাখার নেতৃবৃন্দ রিডিং রুমে অবস্থান করছে পড়ার ভান করে। আসলে তারা নজরদারি করছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর। এ ছাড়া বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগ কর্তৃক কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের আগে থেকেই ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ ছিল। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত সোমবার কোটা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী তিন যুগ্ম আহ্বায়ককে ডিবি কার্যালয়ে তুলে নেয়ার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন মাত্রায় আতঙ্ক এবং নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে পড়ে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/311752