গুলিস্তান এলাকায় হকার উচ্ছেদের সময় এভাবেই প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজিতে মেতে ওঠে ছাত্রলীগ নেতারা।
১৯ এপ্রিল ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৯

হকার উচ্ছেদে ছাত্রলীগ নেতাদের অস্ত্রবাজি

চার্জশিটে অস্ত্র গুলি কোথায়

গুলিস্তানে হকার উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে তাতে অংশ নেয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের একটি অংশ। এই অভিযানে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করতে করতে সামনে এগিয়ে যান দক্ষিণ ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেন। তাঁর সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ছিলেন ওয়ারি থানা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান। ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলিবর্ষণের বহুল আলোচিত ওই ঘটনায় গত ১০ এপ্রিল পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। তবে অভিযোগপত্রে অভিযুক্তদের নানা কৌশলে রক্ষা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। হাজারো মানুষের সামনে সাব্বির ও আশিকের অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট আইনে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মামলার এজাহারে অজ্ঞাতপরিচয় ৫০-৬০ জনের নাম উল্লেখ করা হলেও অভিযোগপত্রে তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি বলা হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া ছবি এবং কালের কণ্ঠ’র হাতে থাকা ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, হকার উচ্ছেদের ওই অভিযানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগ, ওয়ারী, পল্টন, মতিঝিল, বংশাল, শাহজাহানপুর, কোতোয়ালি, শাহবাগ, সূত্রাপুরসহ বিভিন্ন ইউনিটের ছাত্রলীগের পদধারী নেতারা অংশ নেন। এ ছাড়া ওই ঘটনার পর থেকে অভিযোগপত্র দাখিল করা পর্যন্ত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের কোনো তৎপরতাও লক্ষ করা যায়নি। মামলা দায়েরের পরও আসামিরা প্রকাশ্যে চলাফেরা করলে পুলিশ জামিনের কথা বলে অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টি এড়িয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশের সহযোগিতায় আইনের ফাঁক দিয়ে এই অস্ত্রধারীদের এখন বেরিয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমন গুরুতর অপরাধের পর অপরাধীরা পার পেয়ে গেলে ভবিষ্যতে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে।
জানতে চাইলে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা তদন্তে তদন্ত কর্মকর্তাদের আরো দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। পুলিশের অভিযোগপত্রে যদি অস্ত্র প্রদর্শন ও গুলিবর্ষণের বিষয়টি উল্লেখ থাকে তবে অস্ত্র আইনে মামলা থাকা দরকার। আর অস্ত্র আইনে পুলিশ যদি পৃথক মামলা করে তাহলে অভিযোগপত্রে তার উল্লেখ থাকতে হবে। না হলে মামলায় ফাঁক থেকে যাবে। এর সুযোগ নিয়ে আসামিরা খালাস পেয়ে যাবে। পুলিশের দাখিল করা অভিযোগপত্রে বোঝা যায়, আসামিদের বাঁচানোর একটা চেষ্টা রয়েছে।’
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ওসি মো. আবুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অস্ত্র উদ্ধার করতে পারিনি বলে অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়নি। অভিযোগপত্রেও এর উল্লেখ নেই। অস্ত্র আইনে মামলা করতে হলে অবশ্যই অস্ত্র উদ্ধার থাকতে হয়।’

২ জন ছাড়া অন্যরা অজ্ঞাত : কালের কণ্ঠ’র হাতে থাকা ভিডিও ফুটেজে প্রায় ২০ জন ছাত্রলীগ নেতাকে শনাক্ত করা গেছে। অথচ পুলিশ তাঁদের দাখিল করা অভিযোগপত্রে কাউকে চিহ্নিত করা যায়নি বলে উল্লেখ করেছে। ঘটনার দিন যখন গোলাপি ফুলহাতা শার্ট পরা সাব্বির হোসেনকে রিভলবার উঁচিয়ে ফাঁকা গুলি করতে দেখা যায় তখন সাব্বিরের পাশে নীল টি-শার্ট পরা আশিকের হাতে দেখা যায় পিস্তল। একই সঙ্গে ছিল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাউসার হোসেন শান্ত, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান অনিক, হাসান ইবনে বাশার, আশরাফুল করিম সাগর, মো. আতিকুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মামুন, ইমরান হোসেন, গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক সাইদুর রহমান শৈকত, উপগ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক আমীর আফজাল জনি, সহসম্পাদক শহীদ চৌধুরী আহম্মেদ শান্ত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন আনু, বংশাল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান হোসেন জন, সূত্রাপুর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মিরাজ হোসেন, কোতোয়ালি থানা ছাত্রলীগের সভাপতি নূরুল আমীন নূরু, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি পলাশ মজুমদার, শাহজাহানপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হামিদ, পল্টন থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুমন, শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের নেতা বাবু, যুবলীগ নেতা মিকুসহ অর্ধশত যুবক।

এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ওসি মো. আবুল হাসান বলেন, ‘আমরা কাউকে শনাক্ত করতে পারিনি বলে এভাবে অজ্ঞাত রেখেই অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। এর বাইরে আমাদের কিছু বলার নেই।’
পুলিশের দাখিল করা মামলার অভিযোগপত্রে দেখা যায়, গত ১০ এপ্রিল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ ঘটনার অভিযোগপত্র জমা দেন শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আকরাম হোসেন। অভিযোগপত্রে এজাহারভুক্ত দুই আসামি সাব্বির হোসেন ও আশিকুর রহমানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর অজ্ঞাতপরিচয় ৫০ থেকে ৬০ জনের কারো নাম-ঠিকানা জানা যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩২৩/৩০৭ ধারায় অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। এসব ধারায় অপরাধের সংশ্লিষ্ট ধারা না থাকায় সাজাও কম রয়েছে।
দণ্ডবিধির ১৪৭ ধারায় দাঙ্গার শাস্তি দুই বছর, ১৪৮ ধারায় মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দাঙ্গা করার অপরাধে শাস্তি তিন বছর, ধারা ১৪৯ মতে সাধারণ উদ্দেশ্য সিদ্ধিকল্পে সংঘটিত অপরাধের জন্য বেআইনি সমাবেশে প্রত্যেক সদস্য দোষী হবে, ৩২৩ ধারা মতে ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাতদানের শাস্তি এক বছর বা অর্থদণ্ড, ধারা ৩০৭ মতে খুনের চেষ্টায় ১০ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, ‘অভিযোগপত্রে গুলিবর্ষণের কারণে খুনের চেষ্টা বলা হলেও যদি অস্ত্র উদ্ধার বা অস্ত্র আইনে মামলা না থাকে, তাহলে আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০৭ ধারা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আসামিরা মামলা থেকে খালাস পেয়ে যাবেন। এখানে সে চেষ্টাই করা হয়েছে।’

পুলিশের অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ ঘটনার বাদীসহ অন্যান্য সাক্ষীদের বক্তব্যও নেওয়া হয়েছে অনেকটা কৌশলে। প্রায় সব সাক্ষীর বক্তব্যই একই ধরনের। অপরাধের গুরুত্ব কমিয়ে দিতে প্রায় সাতজন সাক্ষীর নাম-ঠিকানা পরিবর্তন করে বক্তব্য হুবহু লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া পুলিশ অজ্ঞাত নামধারীদের একজনকেও সাক্ষীদের জবানবন্দিতে আনেনি।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, “প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শন ও গুলিবর্ষণের ঘটনাটি অস্ত্র আইনের ১৯ (ক) (চ) ধারায় মামলা হওয়ার কথা। সেখানে বলা আছে, ‘এ ধারায় কোনো অপরাধ সংঘটন করলে অপরাধ যদি পিস্তল, রিভলবার, রাইফেল, শটগান বা অন্য আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কিত হয়, তবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অন্য কোন কঠোর দণ্ড যার মেয়াদ দশ বৎসরের কম নয়।’ এখন অস্ত্র আইনে যদি মামলা না হয় তবে পুরো মামলাটি হালকা হয়ে যাবে। আর অস্ত্র আইনে মামলা হলেও সেখানে পুলিশের দাখিল করা অভিযোগপত্রে মামলার সংযুক্তি থাকতে হবে। নাহলে সঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে না।”
২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর গুলিস্তানে ফুটপাত ও সড়ক থেকে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এ সময় হকারদের সঙ্গে ডিএসসিসির কর্মচারী ও একদল যুবকের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে যুবকদের মধ্য থেকে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ফাঁকা গুলি বর্ষণ করেন সাব্বির হোসেন ও আশিকুর রহমান। গুলিবর্ষণের ঘটনায় সাব্বির ও আশিককে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। এ ঘটনার চার দিন পর ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত এই দুই নেতার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়। এই দুজনসহ অজ্ঞাতপরিচয় ৫০-৬০ জনের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় এসআই আব্দুল মান্নান বাদী হয়ে মামলাটি করেন। শাহবাগ থানায় করা মামলার এজাহারে বলা হয়, ঘটনার দিন দুই থেকে আড়াই শ হকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সামনে জড়ো হয়ে মিছিল করে এবং স্লোগান দেয়। পুলিশ সদস্যরা তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টায় ছিলেন। তখন সিটি করপোরেশনে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা প্রায় ২০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে হকারদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। এ সময় দুই ছাত্রলীগ নেতা হত্যার উদ্দেশ্যে মিছিলকারীদের গুলি করলে মিছিলকারী হকাররা আত্মরক্ষায় মাটিতে শুয়ে পড়ে। ওই ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গী আরো ৫০-৬০ জন হকারকে মারধর ও ধাওয়া করলে তারা সিটি করপোরেশনের কার্যালয় থেকে বের হয়ে যায়। সাব্বির, আশিকুরসহ ওই ৫০-৬০ জন লাঠিসোঁটাসহ মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মিছিলকারীদের ওপর আক্রমণ, মারধর ও হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে অপরাধ করেছে।
সংঘর্ষের মধ্যে গোলাপি ফুলহাতা শার্ট পরিহিত সাব্বির রহমানকে রিভলবার উঁচিয়ে ফাঁকা গুলি করতে দেখা যায়। সে সময় সাব্বিরের পাশে নীল টি-শার্ট পরিহিত আশিকের হাতে দেখা যায় পিস্তল। সেই ছবি পরদিন দেশের সবগুলো সংবাদপত্রে ছাপা হয়।

গুলিবর্ষণের ঘটনার পর সাব্বির ও আশিক বেশ কিছুদিন পালিয়ে থাকেন। আসামিরা যাতে দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে না পার্নে সে জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে একই বছরের ১ নভেম্বর ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে চিঠি লেখা হয়। একই বছরে আসামিদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স আছে কি না তা জানতে ওই বছর ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চিঠি দেয় পুলিশ। কিন্তু অস্ত্র বৈধ না অবৈধ তা পুলিশ আর অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেনি। এরই মধ্যে সাব্বির ও আশিক ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেন। জামিন নিয়ে আসামিরা পালিয়ে যান। এরপর ডিসেম্বরের ৪ তারিখ আদালত তাঁদের অনুপস্থিতিতে জামিন বাতিল করেন। আবার ২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আসামিরা আদালতে হাজির হলে আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠান। এরপর ১৩ ফেব্রুয়ারি আবার জামিনে বের হয়ে আসেন এই দুই অস্ত্রধারী। এর পর থেকে সাব্বির রাজধানীর বংশালের সিদ্দিকবাজার এলাকায় নিজ বাসায় বসবাস করেন।

 

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/04/19/626576