১৯ এপ্রিল ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৪০

চালকের অধৈর্য ও ক্লান্তি দায়ী

ফিটনেসবিহীন ও ত্রুটিপূর্ণ গাড়ির ছড়াছড়ি * নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৩৪ লাখ আর লাইসেন্স সাড়ে ২২ লাখ * গত বছর ফিটনেস নিয়েছে ৬ লাখ ৩২ হাজার


সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমছে না। অদক্ষ, প্রশিক্ষণহীন ও লাইসেন্সবিহীন চালকের কারণে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। এর জন্য দায়ী চালকের বেপরোয়া মনোভাব। চালকের অধৈর্য, অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও ক্লান্তি দুর্ঘটনার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। একজন চালকের দিনে ৮ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর নিয়ম থাকলেও চালান ১২-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত। গন্তব্যে তাড়াতাড়ি যেতে চালক বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান। এছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালানোর শক্তি ধরে রাখতে অনেক চালক মাদক নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা ও এর আশপাশের জেলায় দিনভিত্তিক গাড়ি ভাড়ায় চালান চালকরা। কম সময়ে বেশি যাত্রী পরিবহনে তারা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। যুগান্তরের কাছে মালিক ও শ্রমিক নেতারা এসব কথা স্বীকার করেছেন। তারা জানান, দুর্ঘটনার জন্য বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও দায় রয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান কঠোর ভূমিকা নিলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে।

বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৩৩ লাখ ৮৯ হাজার। অপরদিকে ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা সাড়ে ২২ লাখ। এ হিসাবে বৈধ চালক দিয়ে সাড়ে ১০ লাখ গাড়ি চালানো হয়। অপরদিকে, গত বছর (জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর) মাত্র ৬ লাখ ৩২ হাজার গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়েছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মতে, সারা দেশে চলাচলকারী যাত্রীবাহী ও মালবাহী গাড়ির সংখ্যা ৮-১০ লাখ। কিন্তু এর কোনো পরিসংখ্যান ও নিয়ন্ত্রণ নেই। অথচ বিআরটিএ’র ওয়েবাসইটে ৫৩ হাজার ফিটনেসবিহীন গাড়ির উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলেন, দুর্ঘটনা ঠেকাতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বিআরটিএ চালকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। পেশাদার চালকদের লাইসেন্স পেতে প্রশিক্ষণ সনদ নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সচেতনতা বাড়াতে অনেক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম যুগান্তরকে বলেন, সড়ক-মহাসড়কে গাড়ি চালানোর মতো পরিস্থিতি নেই। মহাসড়কে অবৈধ নসিমন, করিমন, ভটভটি চলাচল করে। রাস্তার দুই পাশে বাজার বসানো হয়েছে। ঢাকার রাস্তায় রিকশা, মোটরসাইকেল, ছোট গাড়ির কারণে বড় গাড়ি চলতে পারে না। এতে চালকরা ক্লান্ত ও অধৈর্য হয়ে পড়ে। এসব কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি আরও বলেন, বিআরটিএ ও জেলা প্রশাসকরা অবৈধ যান চলাচল এবং স্থাপনা উচ্ছেদ করেন না। প্রতিটি জেলার রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট অথরিটি সিএনজি ও লেগুনা অনুমোদন দেয়। কিন্তু পরিবহন খাতে তাদের নজর নেই। একজন চালককে দিনে ৮ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর নিয়ম সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যানজটে গন্তব্যে যেতে কত ঘণ্টা সময় লাগবে তা কেউ জানেন না। এ কারণে ৮ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর নিয়ম থাকলেও গন্তব্যে না যাওয়া পর্যন্ত চালক পরিবর্তন করা যায় না। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান ও গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা নিয়ে তিনি বিআরটিএর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলেন। পরিবহন শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, মালিক ও চালকের অসাবধানতার কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। ঢাকায় চালকের কাছে গাড়ি চুক্তিতে দেয়া হয়। বেশি যাত্রী তুলে অল্প সময়ে গন্তব্যে যেতে বেপরোয়া হয়ে উঠেন চালক। এতে চালকরা রেষারেষি করে গাড়ি চালান। তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের মৃত্যু এর বড় উদাহরণ। মালিক ও চালক সবাই সচেতন হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। তিনি আরও বলেন, মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য চালক ও রাস্তার দুই পাশের হাটবাজার দায়ী। সম্প্রতি দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়া চালকদের সচেতন করতে নতুন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিআরটিএ। বাস ও ট্রাক টার্মিনালে মাইকিং করে চালকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো হবে। পাবলিক প্লেসে সচেনতামূলক স্টিকার ও লিফলেট বিতরণ করা হবে। জানা গেছে, সম্প্রতি দুই গাড়ির রেষারেষিতে রাজীব দুর্ঘটনার শিকার হন। এ কারণে স্বজন পরিবহনের বাসটির (ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৯১১৯) রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভারি যানবাহনের ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ চালক ‘ওস্তাদ’র (মূল চালকের) সহকারী থেকে চালক হয়েছেন। তারা গাড়ি চালানোর কোনো নিয়ম জানে না। আর বুয়েটের হিসাব মতে, বাংলাদেশে যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে তার মধ্যে ৬৮ দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য বাস ও ট্রাক দায়ী। ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ দায়ী বাস এবং ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ দায়ী ট্রাক। আর চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে।

পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, বাস-মিনিবাস, লরি দিনে ১২-১৬ বা ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত চলে। এ ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিটি যানে অন্তত দু’জন চালক থাকার নিয়ম। কিন্তু কখনও একটি গাড়িতে দু’জন চালক থাকে না। একজন চালক থাকায় অনেক ক্ষেত্রে হেলপার গাড়ি চালায়। এছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালানোর ক্লান্তি দূর করতে চালক ও সহকারীরা ইয়াবাসহ মাদক সেবন করেন। নেশার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। বিআরটিএ সূত্র আরও জানায়, দেশে দক্ষ চালকের সংকট রয়েছে। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিআরটিএ এর রেজিস্ট্রার্ড গাড়ির সংখ্যা ছিল এক লাখ ৭৫ হাজার। ২০১৭ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৩৩ লাখে। প্রতি বছর এ সংখ্যা বাড়ছে। ১৯৮৭ সালে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল এক লাখ ৯০ হাজার, ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ২২ লাখ ৪২ হাজার ৪৬৫টিতে দাঁড়ায়। এরমধ্যে পেশাদার চালকের সংখ্যা ১০ লাখ ৪১ হাজার ৬৯৭। এ সংক্রান্ত কাপজপত্রে আরও দেখা গেছে, ভারি গাড়ি চালনার লাইসেন্স আছে এক লাখ ৩০ হাজার ৪৬৮টি। মাঝারি গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ৪৬ হাজার ৫৫৩, হালকা যানের জন্য ১২ লাখ ৪৭ হাজার ৩৫০টি। থ্রি হুইলার লাইসেন্স আছে ৪৯ হাজার ১২টি, মোটরসাইকেলের লাইসেন্স রয়েছে ৭ লাখ ৬৮ হাজার ২৭৬টি এবং অন্য ক্যাটাগরিতে আছে ৮০৬টি লাইসেন্স।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/39681