রাজধানীর উত্তরা কুশল সেন্টারের সামনে ইউলুপ নির্মাণের জন্য রাস্তা খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে
১৯ এপ্রিল ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৭

প্যাঁচে রাজধানীর ইউটার্ন প্রকল্প

অন্তহীন উন্নয়নের কবলে ঢাকা

‘বোধগম্য নয়’-এর প্যাঁচে পড়েছে রাজধানীর ইউটার্ন প্রকল্প। সরকারের দু’টি প্রতিষ্ঠান এই বোধগম্যতার রশি টানাটানি করতে গিয়ে যানজট নিরসনের এ উত্তম উন্নয়ন প্রকল্পটি ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ বুঝতে পারছে না কেন এই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। অপর দিকে সড়ক ও জনপথ বিভাগ কেন কাজে বাধা দিচ্ছে তা বোধগম্য নয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের। আর এতেই ধুঁকছে ইউটার্ন প্রকল্প।

রাজধানীর যানজট নিরসনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে উত্তরা হাউজবিল্ডিং পর্যন্ত ১১টি ইউটার্ন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। গত বছর এই প্রকল্পের কাজ শুরু করে চলতি বছর জুন মাসে এটি সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও এখনো এর ২০ ভাগ কাজও শেষ হয়নি। কয়েকটি স্থানে কাজ শুরুই করা যায়নি। বাকি জায়গায় কাজ বন্ধ হওয়ার পথে। উপরন্তু বেশির ভাগ পয়েন্টেই রাস্তার দুই পাশে খুঁড়ে রাখার কারণে বর্ষার মওসুমে চরম ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীকে এর খেসারত দিতে হচ্ছে। এ দিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) জায়গার বিনিময়ে টাকা চাওয়ায় প্রকল্পের কাজে কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে সওজ বলছেÑ সেসব জায়গায় তারা বাধা দেয়নি সেখানেও কাজ শুরু করেনি ডিএনসিসি।
রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের ক্রসিং পয়েন্টে যানজট লেগে থাকা নিত্য বিষয়। আনিসুল হক ডিএনসিসির মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তেজগাঁও থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কের যানজট নিরসনের উদ্যোগ নেন। এ জন্য ইউটার্ন নির্মাণের প্রস্তাব দেন। পরে বিভিন্ন সেবা সংস্থা, মেট্রো রেল প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক হয়। রাজধানীর সাতরাস্তা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত মোট ২২টি ইউটার্ন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মধ্যে ডিএনসিসির সাতরাস্তা থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত ১১টি এবং টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত আরো ১১টি নির্মিত হবে। প্রথমে একক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিলেও পরে পৃথকভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ডিএনসিসি উত্তরার হাউজবিল্ডিং থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তা পর্যন্ত ১১টি পয়েন্টে ইউটার্ন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এগুলো হলো তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা, নাবিস্কো মোড়, মহাখালী বাস টার্মিনাল, বনানী চেয়ারম্যানবাড়ি, বনানী কবরস্থানের সামনের মোড়, বনানী ওভারপাস, আর্মি গলফ কাব, কাওলা, উত্তরার র্যাব-১ অফিসের সামনের সড়ক, জসিমউদ্দীন এভিনিউয়ের মোড় ও উত্তরা হাউজ বিল্ডিংয়ের সামনের মোড়। এ জন্য ব্যয় ধরা হয় ২৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৯ কোটি ৮৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেবে সরকার। বাকি ৪ কোটি ৯৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেবে ডিএনসিসি। ২০১৮ সালের জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। গত বছরের ২৯ অক্টোবর এসএম কনস্ট্রাকশনকে ইউটার্ন নির্মাণের কার্যাদেশ দেয় ডিএনসিসি। কিন্তু এ পর্যন্ত একটি ইউটার্ন নির্মাণ শেষ হয়নি।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইউটার্ন হলো সড়কের ক্রসিং পয়েন্টে রাস্তার দুই পাশের কিছু জমি সংযোজন করে সেখানে ডানে টার্ন নেয়ার জন্য একটি লেন করে দেয়া হবে। সেই লেন ব্যবহার করে গাড়িগুলো ডানে টার্ন নিতে পারবে। এতে যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। ক্রসিংগুলোতেও সিগন্যালের জন্য আর গাড়িগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বিদ্যমান রাস্তার ওপরেই তৈরি করা হবে ইউটার্ন। বিটুমিন দিয়ে তৈরি রাস্তার মতো যাতে দ্রুত ভেঙেচুরে না যায় সে জন্য ইউটার্নের লেনগুলো তৈরি করা হবে কংক্রিট দিয়ে। আর ওই পয়েন্টে লেনের বাইরে যেটুকু উš§ুক্ত স্থান থাকবে সেখানে করা হবে ফুলের বাগান। এতে যানজটের যেমন নিরসন হবে, তেমনি বাড়বে নগরীর সৌন্দর্যও। ১১টি ইউটার্ন নির্মিত হলে ঢাকা শহরের ২৫ শতাংশ যানজট কমবে বলে তাদের আশা।
এ দিকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদনের পরও সরকারি সংস্থাই প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা প্রদান করছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইএমইডি থেকে প্রকল্পের সরেজমিনে পরিদর্শনে চিত্র হলো, তেজগাঁও সাতরাস্তা এলাকায় ইউটার্নের দৈর্ঘ্য ২৯৭.৬৪ মিটার এবং প্রস্থ ৫৩.০৫ মিটার। বিদ্যমান ইউটার্নটি ভূমি জরিপ অফিসের বাউন্ডারি ওয়াল সংলগ্ন প্রায় ২৬৪দ্ধ১০ ফুট জায়গা বিস্তৃত। তবে ভূমি জরিপ অফিসের এই জমি এখনো পাওয়া যায়নি। অন্য প্রান্তে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের দেয়ালের ভেতরে বেশ জায়গা রয়েছে। কিন্তু সেই জায়গা আজো পাওয়া যায়নি। আবার ভূমি জরিপ অফিসের অপর পাশে পিডব্লিউডির নির্মিত বহুতল ভবণের সামনে ৩০০ ফুটদ্ধ১৪ ফুট জায়গাও এই ইউটার্ন নির্মাণের জন্য প্রয়োজন, যা এখনো পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া গাছ ও বিদু্যুতের পোল রয়েছে। এসব কারণে ওই এলাকায় কাজ শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

নাবিস্কোতে ইউটার্নের দৈর্ঘ্য ১০৯ মিটারদ্ধপ্রস্থ ৩৬.৫৮ মিটার। এটার জন্য কোহিনূর কেমিক্যালের জায়গার প্রয়োজন। তার জন্য প্রতিষ্ঠানটির স্থাপনা ভাঙতে হবে। কিন্তু তারা সেটা ভাঙতে বাধা প্রদান করায় প্রকল্পের কাজ ওই স্থানে বন্ধ রয়েছে। আর মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকার ইউটার্নটির আকার ১৯৯.৮৫ মিটারদ্ধ৫৬.৭০ মিটার। এটি নির্মাণে জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের ভেতরের প্রায় ৪০ ফুট জায়গা প্রয়োজন। কিন্তু জায়গা এখনো পাওয়া যায়নি। এমনকি পশ্চিম পাশে সওজের জায়গাও এর আওতাভুক্ত, যা এখনো পাওয়া যায়নি।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকার ইউটার্নটির আকার ১৪২.২২ মিটারদ্ধ৪২.৬৮ মিটার। সওজ বিভাগের প্রায় ১১ ফুটদ্ধ৪৬০ ফুট জায়গা এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত। কিন্তু ওই জায়গা না পাওয়ার কারণে কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি বলে আইএমইডি জানায়। এ ছাড়া বনানী কবরস্থান এলাকার ইউটার্নটির আকার ১২৬.৮৩ মিটারদ্ধ৪০.৫৪ মিটার। প্রকল্পের এলাকার মধ্যে পরিবেশ সার্কেল কর্তৃক রোপণকৃত গাছ ও টব রয়েছে, যা অপসারণ করা দরকার। এ ছাড়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অ্যালাইনমেন্ট বরাবর ইউটার্নটি অবস্থিত। ওখানে কাজ করা যাচ্ছে না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, আর্মি গলফ কাব এলাকাতে ইউটার্নের আকার ১৪০.৯৭ মিটারদ্ধ৩৯.৯০ মিটার। সেখানে সওজের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলমান। ফলে প্রকল্পের কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। কাজ শুরু করতে গেলে সওজ দুই দফা বাধা প্রদান করে। ফলে প্রকল্পের কাজ এখন বন্ধ। কাওলা ফাইং কাব এলাকার ইউটার্নটির আকার ২৩৪.২৬ মিটারদ্ধ৫১.৫৫ মিটার। সেখানে সওজের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলমান। সওজের বাধায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। আর উত্তরা র্যাব-১ কার্যালয়ের সামনে ১৮০.১৩ মিটারদ্ধ৫১.৫৫ মিটার আকারের ইউটার্ন হবে। দুই সাইডে বিদ্যুতের পোল এবং বিভিন্ন গাছপালা থাকায় সেখানে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। তবে গত ১৩ এপ্রিল থেকে সেখানে আবার কাজ শুরু হয়েছে। উত্তরা হাউজবিল্ডিং এলাকায় ১৩৩.১৮ মিটারদ্ধ৩৮.১০ মিটার আকারের ইউটার্ন হবে। ওই জায়গাটি বিআরটিএর। সেখানে তাদের প্রকল্প রয়েছে। সে স্থানেও সওজ বাধা প্রদান করছে। যার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে সম্প্রতি সেখানে আবার কাজ শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। গত ১৩ এপ্রিল সেখান ১০ জন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়।
ইউটার্ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ডিএনসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার মাহবুব আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, ২০১৫ সাল থেকে এ প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়। সর্বশেষ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাথে অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভা থেকে এ ব্যাপারে সম্মতি দেয়া হয়। বলা হয় প্রকল্পের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ), সিভিল এভিয়েশন ও রেলওয়ের কিছু জমি ব্যবহƒত হবে। এ ব্যাপারে প্রথমে টাকা-পয়সার কোনো কথা হয়নি। কিন্তু পরে কাজ শুরু করতে গেলে সওজ ১ দশমিক ৩৬ একর জমির দাম চায়। এ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানায় ডিএনসিসি।

ইউটার্ন নির্মাণের দায়িত্বে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসএম কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী হাসিবুর রহমান শাহিন নয়া দিগন্তকে বলেন, সওজের অন্যায্য দাবির কারণে মেয়র আনিসুল হকের একটি ভালো উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে। প্রথমে যখন ইউটার্নের কাজ শুরু করা হয় তখন সওজের লোকজন এসে বাধা দেয়। আর্মি গলফ কাব ও তেজগাঁও সাতরাস্তা পয়েন্টের সাইনবোর্ড দু’টি রাতের বেলা কে বা কারা ভেঙে নিয়ে যায়। ক্ষতিপূরণ না দেয়া পর্যন্ত তারা কাজ বন্ধ রাখতে বলে। এ কারণে উত্তরা হাউজ বিল্ডিংয়ের সামনে কাজ শুরু করার পর বন্ধ করে দেয়া হয়। সম্প্রতি সেটিতে আবার কাজ শুরু করা হয়েছে। এ ছাড়া র্যাব-১ কার্যালয়ের সামনের সড়কেও কাজ শুরু করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী ইকবাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ডিএনসিসিকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শর্ত দেয়া হয়েছিল, যেসব স্থাপনা সরাতে হবে সেজন্য তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ইউটার্ন নির্মাণে যেসব স্থাপনা ভাঙ্গা পড়ছে সেসবের তিপূরণ নির্ধারণ করে ডিএনসিসিকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা ক্ষতিপূরণ দিলেই ডিএনসিসি কাজ করতে পারবে। মেহেদি ইকবাল আরো বলেন, এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছিল। তারপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। মেহেদী ইকবাল আরো বলেন, বিমানবন্দর থেকে আব্দুুল্লাহপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের জন্য জমি দেয়া হয়েছে। সেখানে অল্প সময়ের মধ্যেই কাজ শুরু হবে। ফলে ইউটার্ন নির্মাণের অনুমতি দেয়া সঠিক হবে না। কারণ এত টাকা দিয়ে একটি প্রকল্প করার পর তা যদি বেশি দিন না টেকে তাহলে অর্থের অপচয় হয়। তারপরও ডিএনসিসি কোন স্বার্থে ইউটার্ন করতে চাচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। তা ছাড়া সাতরাস্তা-নাবিস্কোতে তাদের কাজ করার সুযোগ থাকলেও সেখানে তারা কেন কাজ করছে না তা বুঝতে পারছি না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাঈদ আনোয়ারুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, ইউটার্ন একটি সাময়িক প্রকল্প। এটি নির্মাণে বিআরটি প্রকল্পের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তারপরও সওজ থেকে বাধা দেয়া হচ্ছে। এটা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/311429