১৮ এপ্রিল ২০১৮, বুধবার, ৯:৩৯

রডের কাঁচামালের উচ্চমূল্য

রডসহ যাবতীয় নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য যেমন হু হু করে বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি রড তৈরির কাঁচামাল লোহা-লক্কর ও স্টিলজাত সামগ্রীর দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। উৎসে কাঁচামালের উচ্চমূল্য ও জোগানে ঘাটতির কারণে বাজারে পড়েছে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব।
এমএস রডসহ লোহাজাত নির্মাণ সামগ্রী উৎপাদনের প্রধান উৎস চট্টগ্রামের সীতাকুÐ উপকূলে অবস্থিত শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের পুরনো অকেজো (স্ক্র্যাপ) জাহাজ, ট্যাঙ্কারের লোহা-লক্কর। টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপ জাহাজের বর্ধিত চড়া মূল্য অপরিবর্তিত রয়েছে। স্ক্র্যাপ জাহাজের জোগানও কিছুটা কমে গেছে। সেই সাথে দেশে বিলেট তৈরি ও রডসহ বিভিন্ন ধরনের নির্মাণ সামগ্রীর উৎপাদনে ব্যবহৃত হরেক রকমের অত্যাবশ্যকীয় রাসায়নিক দ্রব্যের দাম বিশ্ব বাজারে প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। গ্যাস-বিদ্যুৎ ঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধি, সড়কপথে পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। টাকার বিপরীতে ডলারের আরো চড়া দাম এবং শুল্ক-করভারের চাপে বিলেট আমদানি কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে উৎপাদন খরচ পুষিয়ে তোলা সম্ভব হয় না। এসব আনুষঙ্গিক কারণে রডসহ লোহাজাত নির্মাণ সামগ্রীর সমগ্র বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। নির্মাণ শিল্প, উন্নয়ন খাত-উপখাতগুলোতে ধস নেমেছে।

নির্মাণ সামগ্রীর বেচাকেনাও হ্রাস পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীগণ একের পর এক শুল্ককর-সারচার্জ-ভ্যাট-মাশুলের চতুর্মুখী চাপ তথা অস্বাভাবিক করভারের বিষয়ে অবিলম্বে সরকারের কাছে যৌক্তিক ও সুষ্ঠু সমাধানের মাধ্যমে বর্তমান সমস্যার উত্তরণ এবং শিল্প-কারখানা টিকিয়ে রাখতে উপযুক্ত প্রণোদনা চান শিল্প-মালিক, উৎপাদকগণ। এরফলে রডসহ নির্মাণ সামগ্রীর বাজার স্থিতিশীল হয়ে আসবে এমনটি তারা আশা করছেন। এদিকে গতকাল (মঙ্গলবার) সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাত-উপখাতে অনুসন্ধানে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, শুল্ক-করভারের ক্ষেত্রে ভারসাম্য না থাকা, ডলারের বিপরীতে টাকার আরও অবমূল্যায়ন- প্রধানত এই তিনটি কারণে রডসহ নির্মাণ সামগ্রীর উৎপাদনের উৎসস্থলে উচ্চমূল্য গুণতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বিলেটের মূল্য গত এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ২৮ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে এখন দাঁড়িয়েছে প্রতিটন ৪৯০ থেকে ৫১০ ডলার। দুই বছর ধরেই বিলেটের মূল্য বাড়ছে। সেই সঙ্গে আমদানিকৃত বিলেট খালাস করে কারখানায় পৌঁছা পর্যন্ত বিভিন্ন শুল্ক-কর-মাশুল আর ভ্যাট মিলিয়ে পরিশোধ করতে হয়ে প্রায় ৪২ শতাংশ পর্যন্ত। এতে করে আমদানিকৃত বিলেট দিয়ে রড বা লোহাজাত কোনো নির্মাণ সামগ্রী উৎপাদন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। স্পঞ্জ আয়রন আমদানিতেও বিরাজ করছে একই সমস্যা।
এ অবস্থায় রডসহ নির্মাণ সামগ্রীর কাঁচামালের প্রধান যে উৎস অর্থাৎ স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে সংগৃহীত লোহা-লক্কর সে ক্ষেত্রেও মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পুরনো অকেজো বা স্ক্র্যাপ জাহাজ, ট্যাংকারের ক্রয়মূল্য পড়ছে বর্তমানে প্রতিটন ৪৩২ থেকে ৪৬৫ ডলার দরে। প্রাপ্তির ঘাটতি, টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বেড়ে গিয়ে এক বছরের ব্যবধানে স্ক্র্যাপ জাহাজের মূল্য বেড়ে গেছে ১৬ শতাংশেরও বেশি। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে অকেজো জাহাজ, বাতিলকৃত লোহা-লক্কর এবং বিলেটসহ দেশে বছরে ৪৬ লাখ মেট্রিক টন রড ও লোহাজাত নির্মাণ সামগ্রী তৈরির কাঁচামাল আমদানি করা হয়। এসব কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে রডসহ নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যও আকাশছোঁয়া। গতকাল চট্টগ্রামে গ্রেডভেদে রড প্রতিটন ৬৬ হাজার থেকে ৬৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। গত সপ্তাহ পর্যন্ত রডের দাম টনপ্রতি ৭১ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে উৎপাদন এলাকা চট্টগ্রামের বাইরে বিশেষত দেশের উত্তর, দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিটন ৭০ থেকে ৭২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক মাসের ব্যবধানে টনপ্রতি মূল্য বেড়েছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।

কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি
সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার তথা শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও করভারের কারণে রডসহ নির্মাণ সামগ্রী উৎপাদন খরচ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম-এর পরিচালক (মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস) এনামুল হক ইনকিলাবকে জানান, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে লোহা-লক্করের টুকরা বা পাত সংগ্রহ করে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে কারখানায় ব্যবহৃত হয়। এটি আমরা এখন ক্রয় করছি প্রতিটন ৩৮ হাজার ৫শ’ টাকা দরে। প্রায় এক বছর আগে মূল্য ছিল ২৪ হাজার টাকা, আরও আগে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা। সেই মোল্ডিং স্ক্র্যাপ থেকে আমরা রড তৈরির মধ্যবর্তী কাঁচামাল বিলেট তৈরি করছি। ডলারের মূল্য ৭৯ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বেড়ে এখন হয়েছে প্রায় ৮৪ টাকা। স্ক্র্যাপ জাহাজের দামও বেড়ে গেছে।

এনামুল হক জানান, স্ক্র্যাপ লোহা-লক্কর, টুকরাগুলো কারখানায় গলানোর জন্য (বিলেট তৈরিতে) রাসায়নিক দ্রব্যাদি, বিদ্যুৎ খরচ করতে হয়। এরজন্য ব্যবহৃত অত্যাবশ্যকীয় চীনসহ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানিকৃত রাসায়নিক দ্রব্য গ্রাফাইট ইলেকট্রোডের মূল্য গতবছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রতিটনে ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যের দামও বেড়ে গেছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ খরচও বেড়েছে। সেই সাথে চট্টগ্রাম থেকে উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রড ও নির্মাণ সামগ্রী সড়কপথে পরিবহনে খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে টনপ্রতি ২ থেকে ৩ হাজার টাকা এমনকি আরও বেশি। সরাচার্জ, ভ্যাট, পোর্ট ডিউজ, মাশুলসহ বিভিন্নমুখী শুল্ক-করের ভার লাঘব করা হলে রড বা নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য সহনীয় হয়ে উঠতে পারে। এরজন্য সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ আমরা আশা করি।
রিয়্যাল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-এর কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের চেয়ারম্যান আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী ইনকিলাবকে জানান, নির্মাণ সামগ্রীর উচ্চমূল্যের কারণে নির্মাণ শিল্প এবং উন্নয়ন খাতে ধস সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে আছে। তার উপর উপর্যুপরি মাশুল ভ্যাট শুল্ক-কর ভারে এই খাত জর্জরিত। আজও (গতকাল) আমরা উদ্যোক্তাদের নিয়ে মিটিং করেছি। সমস্যার উত্তরণে সরকারে সময়োচিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।

https://www.dailyinqilab.com/article/126812