১৮ এপ্রিল ২০১৮, বুধবার, ৯:৩৫

ঢামেক হাসপাতাল কার্ডিওলজি বিভাগ

হৃদরোগ চিকিৎসা সেবা বন্ধের পথে

হল্টার, ইকো, ইটিটি মেশিন নষ্ট * অন্যত্র করাতে হয় সব পরীক্ষা * সিসিইউর এসি নষ্ট ৬ মাস

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি (হৃদরোগ) বিভাগের চিকিৎসা সেবা এক ধরনের বন্ধের পথে। হৃদযন্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতিই নষ্ট। মারাত্মক হৃদরোগের আক্রান্ত রোগীদের ঠিকানা করনারি কেয়ার ইউনিটের (সিসিইউ) শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র নষ্ট প্রায় ৬ মাস ধরে। বিভাগে একটি ক্যাথল্যাব থাকলেও অন্য আরেকটি বিভাগের সঙ্গে সেটি যৌথভাবে ব্যবহার করতে হয়। ফলে রোগীদের এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্ট করতে অপেক্ষা করতে হয় দিনের পর দিন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা এ কার্ডিওলজি বিভাগ থেকে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে ৬০টি শয্যা রয়েছে। বহির্বিভাগে প্রতিদিন দু’শতাধিক রোগী আসে। এদের বেশিরভাগই দরিদ্র। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এ বিভাগে ইসিজি ছাড়া হৃদরোগীদের অন্য কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। বহির্বিভাগের রোগীরা সব পরীক্ষা হাসপাতালের বাইরে থেকে করিয়ে আনেন। এমনকি ভর্তি রোগীদেরও হল্টার, ইকো, ইটিটি করাতে হচ্ছে বাইরের ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিকে গিয়ে। ফলে রোগীদের একদিকে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, অন্যদিকে এসব পরীক্ষা করাতে ব্যয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। আবার প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকে এসব পরীক্ষা ব্যয় অত্যন্ত বেশি হওয়ায় অনেকের পক্ষে পরীক্ষা করানো সম্ভব হয় না। ফলে রোগ নির্ণয় না হওয়ায় তাদের বিনা চিকিৎসায় ফিরে যেতে হয়।

হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, হৃদরোগীদের ২৪ ঘণ্টার হার্টের ইসিজি রেকর্ড রাখতে হল্টার মেশিন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু হাসপাতালের এ মেশিনটি প্রায় দু’বছর ধরে নষ্ট। চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে ইটিটি মেশিনও প্রায় দু’বছর ধরে নষ্ট। ইটিটি হল এনজিওগ্রামের পূর্বের পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় হার্টের কোনো ঝুঁকি দেখা দিলে রোগীর এনজিওগ্রাম করতে হয়। এ দুটি মেশিনের পাশাপাশি তিন মাসের বেশি সময় ধরে হাসপাতালের দুটি ইকো কার্ডিওগ্রাফি মেশিনও বিকল। হার্টের প্রকৃত অবস্থা দেখার জন্য ইকো করতে হয়। একজন রোগীর হার্টে কোনো ছিদ্র আছে কিনা, বাল্ব ঠিক আছে কিনা, হার্টে পানি জমে কিনা, শিরা-উপশিরা স্বাভাবিক আছে কিনা ইত্যাদি জানতে ইকোর কোনো বিকল্প নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে ইকো করতে ২০০ টাকা খরচ হলেও বাইরের ক্লিনিকে এ পরীক্ষা করাতে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়। একইভাবে সরকারি হাসপাতালে ইটিটি করতে লাগে ৩০০ টাকা, অথচ বাইরে এটি করাতে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। এ ব্যয় বহন করা অনেক দরিদ্র রোগীর পক্ষে সম্ভব হয় না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে ২১ শয্যার সিসিইউ রয়েছে- মারাত্মক হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের যেখানে রাখা হয়। কিন্তু সিসিইউর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বা এসি প্রায় ছয় মাস ধরে নষ্ট। ফলে গরমে রোগীদের অবস্থা চরমে পৌঁছেছে।
হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে ক্যাথল্যাব মেশিন মাত্র একটি। সেটি নিউরো সার্জারি বিভাগও ব্যবহার করে। ফলে প্রতিদিন হৃদরোগীদের এনজিওগ্রাম এবং এনজিওপ্লাস্ট করা সম্ভব হয় না। এছাড়া হাসপাতালের একজন সহযোগী অধ্যাপকের পদ দুই বছর এবং দু’জন সহকারী অধ্যাপকের পদও এক বছর ধরে শূন্য পড়ে আছে।

হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মহসিন আহমেদ বলেন, মেশিন নষ্ট থাকায় চিকিৎসা সেবা সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে অনেক রোগীকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ফিরে যেতে হচ্ছে। মেশিন নষ্টের বিষয়টি যথাসময়ে কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আশা করছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভাগের কয়েকজন চিকিৎসক বলেন, এসব মেশিন নষ্ট থাকার কারণে শুধু বহির্বিভাগের রোগীরাই নয়, ভর্তি রোগীরাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া অন্য বিভাগের অনেক রোগী বিশেষ করে ইনজুরি ও অপারেশনের রোগীদের হার্টের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা জানান, এসব মেশিনের দাম কম হওয়ায় অনেক সাপ্লায়ার এসব মেশিন সরবরাহ করতে চান না। ফলে একাধিকবার চিঠি দিয়েও কর্তৃপক্ষের কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এসব সমস্যাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দালাল চক্র।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বিভাগের মেশিন নষ্ট থাকায় রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে বিপুলসংখ্যক রোগী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত হবে। তিনি বলেন, এসব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। কিন্তু কেনাকাটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আপাতত প্রয়োজনীয় একটি বা দুটি মেশিন অন্য হাসপাতাল থেকে ধার পাওয়া গেলেও কাজ চালানো যেত। তাতে অনেক রোগীর চিকিৎসা করানো সম্ভব হতো, বাঁচানো যেত অনেক মূল্যবান প্রাণ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/39303