১৮ এপ্রিল ২০১৮, বুধবার, ৯:২৯

গণতন্ত্রের মৃত্যু

আসাদ পারভেজ

মহাবিশ্বের অতি ক্ষুদ্র একটি গ্রহের নাম পৃথিবী। যেখানে স্রষ্টার অসংখ্য সৃষ্টির সাথে বাস করে শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। পৃথিবীতে ৭৩০ কোটি মানবসন্তান বসবাস করে ২৩৪টি দেশে। জাতিসঙ্ঘের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা ভোগ করে ১৯৫টি রাষ্ট্র। জাতিসঙ্ঘ যদিও গণতন্ত্রের কথা বলে, তবু এই ১৯৫টি রাষ্ট্র রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ও গণতন্ত্রসহ বহুতন্ত্র ও ব্যক্তির মনোবাসনায় পরিচালিত হয়। তাহলে জাতিসঙ্ঘ মূলত কোন তন্ত্রে বিশ্বাসী?

রাষ্ট্রের থাকবে স্বাধীনতা। আবার স্বাধীন রাষ্ট্রের থাকবে নির্দিষ্ট সীমার ভূমি আর সেই ভূমিতে গণতান্ত্রিক জনগোষ্ঠী। নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হবে একটি সরকার। থাকবে সুপ্রতিষ্ঠিত বিরোধী দল। প্রত্যেকের থাকবে সঠিকভাবে কথা বলার, চলার ও বেঁচে থাকার অধিকার। এটাই মৌলিক অধিকার। তার অর্থ এই নয় যে, গণতন্ত্র এমন কোনো প্রতিশ্র“তি দেয়, নিজের কণ্ঠস্বর অন্যজনকে অহেতুক বিব্রত করবে।
আমাদের মধ্যে এমন ধারণা বদ্ধমূল যে, গণতন্ত্রের সাধারণত মৃত্যু হয় রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্য দিয়ে; বিশেষ করে, সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।

তবে আজ আর গণতন্ত্রকে জীবন্ত পুঁতে ফেলতে রাস্তায় কোনো সামরিক অফিসারকে বন্দুক ও ট্যাংক নিয়ে নামতে হয় না। গণতান্ত্রিক সরকারের একজন নির্বাচিত জননেতার হাতেও গণতন্ত্রের মৃত্যু হতে পারে।
ফিলিপাইনের দুতার্তে, হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবান, আমেরিকার ট্রাম্প, রাশিয়ার পুতিন, মিসরের সিসি, ভেনিজুয়েলার মাদুরো, কিংবা মিয়ানমারের সু চি সরকারের হাতে নিজ নিজ দেশে গণতন্ত্রের মৃত্যু হচ্ছে। অন্য দেশের গণতন্ত্র হত্যার জন্য এমন কি কেউ কেউ অর্থ, শ্রম, সময় ও কৌশল প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। আমাদের দেশে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে বাকশালের মাধ্যমে অতি সুনিপুণভাবে গণতন্ত্রের প্রাণহরণ করা হয়েছিল।
সংবাদপত্রের হাতে হাতকড়া বাঁধা হলো, বিচারব্যবস্থা কুক্ষিগত হলো, নাগরিক অধিকার বলতে কিছুই বাঁচিয়ে রাখা হলো না।
কোনো রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে এবং প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট হয়ে রাষ্ট্রীয় আসনে আসীন হয়, সে প্রক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটিয়ে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটানো যায়।

আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে তা অহরহ হচ্ছে। আমরা জাতি হিসেবে কতই না লজ্জিত। আমাদের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারপ্রধান পর্যন্ত এমনভাবে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তা প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করলে আমরা বুঝতে পারব, আমরা কেন লজ্জিত। তারা যে ভাষায় কথা বলেন, তা আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য নিতান্তই ক্ষতিকর। দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতা জ্বালাও-পোড়াও তথা দেশের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘœ ঘটে এমন আচরণ করতে উসকানি দেন।
এ কেমন গণতন্ত্র? একটি দেশের সর্বাধিক ক্ষমতাবান যদি স্বেচ্ছাচারী ও কর্তৃত্ববাদী আদর্শের মোহে চলতে থাকেন, তখন জনগণের ভাগ্যে নেমে আসে দুর্ভাগ্য। আল্লাহ পাক কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে তার নেতৃত্বকে স্বেচ্ছাচারী করে তোলেন। কেননা স্বেচ্ছাচারী কোনো ব্যক্তি ক্ষমতায় আসীন হলে তার ফল দাঁড়ায় ওই জাতির সম্পদের বেপরোয়া লুণ্ঠন। এর প্রতিবাদ করলেই গুম, হত্যা, মামলা, নির্যাতন সঙ্গী।

আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে বনি ইসরাইল সূরার ১৬ নম্বর আয়াতে বলেনÑ ‘কোনো জনপদ ধ্বংস করার আগে সেখানকার বিত্তবান ও প্রভাবশালী লোকদের সৎকর্ম করার নির্দেশ দেই। কিন্তু ওরা আমার আদেশের অবাধ্য হয়ে অন্যায় ও জুলুমে লিপ্ত হয়। তখন ন্যায়সঙ্গতভাবেই আজাবের ফয়সালা হয়ে যায় এবং তারা ধ্বংস হয়।’
মিয়ানমারের সু চি সরকার ও তার সামরিক দোসররা রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাখির মতো হত্যা করলেও আমাদের সরকার বাণিজ্যচুক্তি কিংবা চাল আমদানিতে ব্যতিব্যস্ত। সত্যিই আমরা জাতি হিসেবে দুর্ভাগা।
সরকারের প্রধান নেতার হীনমানসিকতার ফলে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র ধ্বংস হতে পারে। স্বেচ্ছাচারী নেতার কর্তৃত্ববাদী আচরণে গণতন্ত্রের মৃত্যু এমনভাবে হয়, যা সাধারণ মানুষ টেরই পান না। কোনো কোনো সময় তারা ‘আইনসিদ্ধ’ পথে জাতিবিরোধী কার্যক্রমের পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনার জন্য আন্দোলন করে সফল হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হন। তিনিই ২০০৮ সালে সামরিক ব্যক্তিদের অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেন। অতঃপর তিনি আদালতকে ব্যবহার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই করে বাতিল করে দেন।

তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে ভোট যে কখনোই নিরপেক্ষ হয় না, তার জ্বলন্ত উদাহরণ বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির কথিত নির্বাচন। তখন ৩০০ জন এমপির মধ্যে ১৫৩ জন নির্বাচিত হন বিনা ভোটে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে এই সরকার দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা অনুধাবন করতে কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। অর্থমন্ত্রীর একটি বাক্যই যথেষ্ট, হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর তিনি বলেছেন, ‘চার হাজার কোটি টাকা কিছুই না।’ যে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা চুরি হয়, শেয়ারবাজার ধ্বংসকারীদের নেতা দরবেশ উপাধি পান, ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানে সাবেক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা জড়িত থেকে লাখো যুবককে পরিবারের কাছে কলঙ্কিত করে, অহরহ প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, মেধাবীরা বঞ্চিত হয় কোটাপদ্ধতির নামে, সাবেক মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠিত ফারমার্স ব্যাংকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত পাওয়া যায় না, সে দেশ কেমন করে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করে?

নেতাদের মধ্যে আদর্শগত বিভক্তি এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার বাসনা জন্মে। বহু ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স সেই কৌশলকে দীর্ঘায়িত করেছে। নিকট অতীতে আমাদের দেশেও নির্দিষ্ট মাত্রার গণতন্ত্র বিদ্যমান ছিল। কিন্তু আজ কতটুকু আছে, তা আমরা সবাই কম-বেশি অবগত।
আমেরিকায় ট্রাম্পের মতো লোকের নির্বাচিত হওয়া বিশ্বের গণতন্ত্রকে কলঙ্কিত করেছে। ইনি বেশির ভাগ সময় নির্লজ্জের মতো নিজ জনগণের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেন। যা হোক, আমাদের দেশের নেতাদের রাজনৈতিক বড় হাতিয়ার গলাবাজি। তারা নির্বাচনের আগেই ফলাফলকে প্রত্যাখ্যানের হুমকি দেন। ক্ষমতায় বসলে, অব্যাহত চেষ্টা করেন নির্বাচনী সব আইন ও প্রক্রিয়া বদল করে নিজ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য। নির্বাচনকালে পেশি ও অর্থশক্তি প্রয়োগের তাগিদে ক্ষমতায় এসে এগুলো অবৈধ উপায়ে অর্জন করা হয়। ইতিহাসকে বিকৃত করেন এসব কর্মকাণ্ডের হোতারাই।
হিটলার থেকে মুসোলিনি কিংবা বুশ থেকে মুগাবে কেউ ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে পারেননি। এ দেশেও জনগণের ভোটাধিকার খর্ব করে কেউ নিজেকে চিরঞ্জীব করতে পারবেন না। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পচনের কারণে দেশে দেশে যেসব স্বেচ্ছাচারী নেতার জন্ম হচ্ছে, তাদেরকে সচেতন মহল মোকাবেলা না করলে দেশ অঙ্কুরেই গণতন্ত্র হারাবে।

বাংলাদেশ তার নিজ গুণেই গণতন্ত্রের লালন করবে, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া হবে, এই দেশ মানবতার দিক থেকে মডেল হয়ে থাকবে, এই আমাদের প্রত্যাশা।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/311111