১৭ এপ্রিল ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৫৩

ইলিয়াস আলী গুমের অর্ধযুগ

ইলিয়াস আলী গুমের অর্ধযুগ আজ। ২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল রাজধানীর রূপসী বাংলা হোটেলে আড্ডা শেষে ফিরছিলেন বনানীর বাসায়। পথে মহাখালী সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে থেকে গাড়িচালকসহ নিখোঁজ হন তিনি। ঘটনাস্থল থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় তার ব্যবহৃত গাড়িটি উদ্ধার করে পুলিশ। ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার ও ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছিল তার নির্বাচনী এলাকা সিলেটের বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জের মানুষ। আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন বেশ কয়েকজন।
দলের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের একজন ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের দাবিতে টানা কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। স্বামীকে উদ্ধারের আবেদন জানাতে সন্তানদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন ইলিয়াস পত্নী তাহসিনা রুশদীর লুনা। নানা তথ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ছুটে গেছেন গাজীপুরসহ কয়েক জায়গায়। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ ৬ বছর। নিখোঁজের পর ইলিয়াস আলীর তথ্য জানতে হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলেন তাহসিনা রুশদীর লুনা। আদালতের নির্দেশনা মেনে কয়েক মাস উদ্ধার অভিযানের তথ্য জানিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সে তৎপরতাও বন্ধ হয়ে গেছে বেশ আগেই। পিতাকে উদ্ধারে ভূমিকা রাখতে বাংলাদেশ সফররত তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের কাছে চিঠি লিখেছিলেন ইলিয়াসের ছোট্ট মেয়ে সাইয়ারা নাওয়াল। দেশের পাশাপাশি তাকে উদ্ধারের দাবিতে বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও মুখর হয়ে উঠেছিল। ইলিয়াস আলীর মোবাইল নম্বর থেকে বিভিন্নজনের কাছে রহস্যময় ফোনকল আসা, ভারতের কারাগারে তার বন্দিজীবন নিয়ে নানা সময়ে গুঞ্জন ছড়ালেও শেষ পর্যন্ত সেগুলো পরিণত হয়েছে গুজবে। পরিবারের সদস্যরা ইতিমধ্যে ২১৯০টি দিন পার করেছেন তার ফিরে আসার অপেক্ষায়। চোখের জল শুকিয়ে গেছে মা সূর্যবান বানুর। দরোজায় কড়া নাড়ার শব্দে এখনো কান পেতে রাখেন স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা। বাবার অপেক্ষায় এখনো আনমনা হয়ে থাকেন সন্তানরা। কিন্তু আজও ফিরেননি ইলিয়াস আলী। তার গাড়িচালক আনসার আলীরও মেলেনি সন্ধান। এদিকে, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথমদিকে ইলিয়াসকে উদ্ধারের জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে দাবি করা হলেও দীর্ঘ ৬ বছরেও তার কোনো সন্ধান দিতে পারেনি তারা। তবুও ইলিয়াস আলী ফিরবেন- এই আশায় এখন বুক বেঁধে আছেন স্ত্রী-সন্তানরা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রথমদিকে বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমসহ বেশ কয়েকজন নেতা নিখোঁজ হন। কিন্তু ইলিয়াস আলী নিখোঁজের পর গুমের বিষয়টি দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে বিএনপি ও অঙ্গ দলের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী নিখোঁজ হন। সে নিখোঁজের প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে কয়েক মাস নিখোঁজ থাকার পর নানা সময়ে বিএনপির বেশকিছু নেতাকর্মী উদ্ধার হয়েছেন। কিন্তু যাকে নিয়ে দেশে-বিদেশে সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ হয়েছে সে ইলিয়াস ফিরেনি।

ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ- রেজিস্ট্রার। বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য পদ পেয়েছেন তিনি। লুনা জানান, অপেক্ষার অনিশ্চয়তা নিয়েই তারা দিন কাটাচ্ছেন। ইলিয়াস আলীর ব্যাপারে নতুন কোনো তথ্য নেই। আশাও দিন দিন ক্ষীণতর হয়ে আসছে। মানুষ আশা নিয়েই বাঁচে, তারাও আশা নিয়েই বেঁচে আছেন। তিনি বলেন, নিখোঁজের পর পুলিশ তো মামলা নেয়নি। বনানী থানায় একটি জিডি করেছিলেন। সে জিডির ভিত্তিতে তেমন কোনো অনুসন্ধান চালানো হয়নি। এখনো জানি না পুলিশের অগ্রগতি কী? হাইকোর্টে রিট দায়েরের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উদ্ধার তৎপরতা সম্পর্কে জানাতে একটি নির্দেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত। কয়েক মাস পর সে নির্দেশ আর রক্ষা করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এখন তো এ ব্যাপারে পুলিশ কোনো কথাই বলতে চায় না। লুনা বলেন, এক সময় নানা গুঞ্জন-গুজব শোনা যেত। এখন সেসবও বন্ধ হয়ে গেছে। তবুও আমি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিশ্বাস রাখতে চাই ইলিয়াস একদিন ফিরে আসবে। তার এলাকার মানুষও এটাই বিশ্বাস করে। লুনা জানান, ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের দাবিতে সিলেটের লোকজন রাস্তায় নেমে এসে প্রাণবিসর্জন দিতেও দ্বিধা করেনি। এ ঘটনায় উল্টো বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীসহ অন্তত ১২ হাজার এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর থানায় দায়ের করা হয়েছিল ৪টি মামলা। সেগুলো এখন বিচারাধীন। ইলিয়াস আলী ফিরে না এলেও মামলার ঘানি টানছেন সিলেটের হাজার হাজার মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে ইলিয়াস আলীর সন্ধান নেই। সিলেট বিএনপির নেতাকর্মীদের দাবির মুখে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন তাহসিনা রুশদীর লুনা। দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে তিনি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদের দায়িত্ব পেয়েছেন। সিলেটের রাজনীতিতে সময় দেন তিনি। স্বামীর নির্বাচনী এলাকার বিএনপি ও অঙ্গ দলের নেতাকর্মীদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ান। লুনা জানান, পারিবারিক জীবনে তারা নিজেরাও কাটাচ্ছেন আর্থিকভাবে দুঃসময়। আইনগত জটিলতার কারণে ইলিয়াস আলীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ। আইনজীবীরা জানিয়েছেন গুমের সাত বছর না পেরোলে অ্যাকাউন্টগুলোতে লেনদেন করতে পারবেন না পরিবারের সদস্যরা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি ও পারিবারিক টুকটাক ব্যবসার আয় দিয়েই সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করছেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য ঋণ করেছেন বাধ্য হয়ে।

লুনা জানান, তাদের তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে আবরার ইলিয়াস যুক্তরাজ্যের বিস্টলে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট ইংল্যান্ডে এলএলবি ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে। ছোট ছেলে লাবিব সারার যুক্তরাজ্যের কভেন্ট্রি ইউনিভার্সিটিতে অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সের সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। ইলিয়াস আলী নিখোঁজের সময় ক্লাস থ্রিতে পড়ুয়া একমাত্র মেয়েটি এখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। লুনা জানান, ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর দুশ্চিন্তায় তিনি নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। হার্টের সমস্যায় ভুগছেন। গত মাসে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। গত ২০ দিন ধরে প্রায় শয্যাশায়ী অবস্থায় রয়েছেন তিনি। অন্যদিকে তার বৃদ্ধা শাশুড়িও অনেকটাই শয্যাশায়ী। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার ৬ বছরের দিনে আজ সিলেট বিএনপির তরফে সিলেট সদর, ওসমানীনগর-বালাগঞ্জ ও বিশ্বনাথে মসজিদে মসজিদে দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকায় বসবাসরত বৃহত্তর সিলেটবাসীর উদ্যোগে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাবে। গতকালও একটি প্রতিবাদী যুব সমাবেশ হয়েছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি-ডিআরইউতে। ইলিয়াস আলীর সন্ধানের দাবিতে লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশিরাও প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=113592