১৭ এপ্রিল ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৪৩

চার বছরেও অগ্রগতি নেই বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়নে

৬০ লাখেরও বেশি দলিত জনগোষ্ঠী বৈষম্যের শিকার; আইন কমিশনের পর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেরও সুপারিশ

আইন কমিশনের পর এবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও ‘বৈষম্য বিলোপ আইন’ প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। মানবাধিকার সংরক্ষণ ও সমাজে বিরাজমান বৈষম্য দূরীকরণে এবং এ-সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিধান কার্যকর করার লক্ষ্যে মানবাধিকার কমিশন গত সপ্তাহে সরকারের কাছে এ সুপারিশ পাঠিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ দিকে বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়নে আইন কমিশন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠালেও চার বছরেও তার বাস্তবায়ন নেই। এ সংক্রান্ত আইন না থাকার ফলে দেশের ৬০ লাখেরও বেশি অনগ্রসর নাগরিক তথা দলিত জনগোষ্ঠী আবাসন, ভূমি, শিক্ষাসহ নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
অনগ্রসর তথা দলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডেমার (সুইপার, পরিচ্ছন্নতা কর্মী), বাল্মিকী (পরিচ্ছন্নতা কর্মী), কলু (ঘানিতে তেলবীজ থেকে তেল তৈরি), ঋষি (মুচি, চামড়া সংশ্লিষ্ট কাজ), বীন, মালা (চা বাগান শ্রমিক), মাদিগা সুইপার, চা বাগান শ্রমিক), ধোপা, নাপিত, বেদে, তাঁতি, হাজাম, মাঝি, কসাই, কায়পুত্র (শূকর পালনকারী), চাকালী, মাইহাল, লালবেগি (পরিচ্ছন্নতা কর্মী), রবিদাস (চা বাগান শ্রমিক ও চামড়া সংশ্লিষ্ট কাজ), বাগদি, বাওয়ালী, বাশফোর, (পরিচ্ছন্নকর্মী), ডোম (মৃতদেহ সৎকারকারী) উল্লেখযোগ্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অনগ্রসর নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা সমান সুযোগ ও পূর্ণ অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল আইন কমিশন বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়নে সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠায়।

ওই সুপারিশে বলা হয়, সরকার প্রতিটি জেলায় ‘বৈষম্য বিলোপ বিশেষ আদালত’ স্থাপন করবে। সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিয়ে সরকার এসব আদালতে বিচারক নিয়োগ করতে পারবে। প্রতিটি জেলার জেলা ও দায়রা জজ তার সাধারণ মামলা ছাড়াও এই আদালতের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। বৈষম্যের শিকার যেকোনো ব্যক্তি প্রতিকার চেয়ে এ আদালতে মামলা করতে পারবেন। মামলার তারিখ থেকে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচারকাজ সম্পন্ন করতে হবে। আবার রায়ের বিরুদ্ধে ৬০ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করা যাবে।
সুপারিশে আরো বলা হয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বৈষম্যমূলক মামলার তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করতে পারবে। কমিশন অনগ্রসর নাগরিক গোষ্ঠীকে মূলধারায় আনতে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারবে।

দণ্ড ও বিচার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত সুপারিশে বলা হয়েছে, ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, শিক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণ এবং কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য প্রথমবার অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা অন্যূন ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান থাকবে। পরবর্তী সময়ে প্রতিবার এ ধরনের অপরাধের জন্য অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা অন্যূন ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রযোজ্য হবে। জনসমাবেশস্থল, সার্বজনীন উৎসব, নিজ ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রবেশ ও অংশগ্রহণে বাধা দিলেও একই দণ্ড প্রযোজ্য হবে। অবহেলিত গোষ্ঠীর কারো জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নাগরিক সেবা পেতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে প্রথমবার অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। পরবর্তী প্রতিবারের জন্য অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
লিঙ্গপ্রতিবন্ধী শিশুকে পরিবারে না রেখে কোনো গোষ্ঠীর কাছে দিলে, লিঙ্গপ্রতিবন্ধী হওয়া ও বাবার পরিচয় দিতে না পারার অজুহাতে শিশুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা না হলে বা নির্যাতন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিলে কিংবা লিঙ্গপ্রতিবন্ধীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে বা সম্পত্তি লাভে বাধা দেয়া হলে অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা অন্যূন ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে আইন কমিশনের সুপারিশে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বৈষম্য বিলোপ আইন করার জন্য আইন কমিশন যে খসড়া পাঠিয়েছিল তার ওপর কাজ চলছে। তবে কবে নাগাদ এ আইন প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন হবে তা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান এবং আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য জেড আই খান পান্না নয়া দিগন্তকে বলেছেন, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে সমমর্যদা প্রদান করা আমাদের নৈতিক ও সাংবিধানিক কর্তব্য।
তিনি বলেন, কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে অনগ্রসর অবস্থায় ফেলে রাখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরুদ্ধ। অনগ্রসর সম্প্রদায়কে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে জাতি গঠনে অগ্রসর ভূমিকা পালন করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। তাই অনতিবিলম্বে বৈষম্য বিলোপ আইনটি প্রণয়ন করা উচিত।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/310874